ছবি: সংগৃহীত
১৯৯৮ সালে বাজারে আসা দৈনিক প্রথম আলো পথচলার ২৭ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে। এ সময়ের মধ্যে পত্রিকাটি ও এর সাংবাদিকেরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত ১৬ বছর স্বৈরাচারী সরকারের আমলে পত্রিকাটি অনেক সত্য কথা বলতে পারেনি।
যতটুকু বলার চেষ্টা করেছে, তাতে তাদের যথেষ্ট চাপের মুখে, বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে। পত্রিকাটির প্রচারসংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার বহু চেষ্টা হয়েছে। সরকারের অনেক বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ব্যক্তি খাতের প্রায় ৫০টি কোম্পানির বিজ্ঞাপনও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
এসব অভিযোগ করেছেন পত্রিকাটির সম্পাদক ও পাঠকনন্দিত সাংবাদিক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন যে, প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, দেশের শত্রু। ওই সরকার চেষ্টা করেছিল প্রথম আলোর মালিকানা কেড়ে নিতে, চেষ্টা করেছিল সম্পাদককে বদল করে দিতে।
তার অভিযোগ, ভারতের এনডিটিভির মালিকানা আদানি গোষ্ঠীর কাছে যাওয়ার মতো শেখ হাসিনা–ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপের কাছে প্রথম আলোর জবরদস্তিমূলকভাবে মালিকানা হস্তান্তরের চেষ্টা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগের গত সরকারের আমলে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রথম আলো এই পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত, জরুরি অবস্থার তত্বাবধায়ক সরকারের আমল পার করেছে। এখন দেখছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
এতো সরকারের মধ্যে শুধু আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে বেশি নির্যাতিত হওয়ার ও ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে থাকার বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান উল্লেখ করেননি মতিউর রহমান। আওয়ামী লীগের সরকারের প্রথম আলোর ‘মালিকানা নিয়ে নেওয়ার ও সম্পাদক বদলের কঠিন উদ্যোগ’ কীভাবে ঠেকিয়েছেন, তা-ও উল্লেখ করেননি মতিউর রহমান। তিনি বলছেন, আমরা এটা বলব না যে সব সময়, সব আমলে, সব সরকারের সময় আমরা সব সত্য কথা বলতে পেরেছি।
বর্তমান সরকারের আমলে প্রথম আলোর অফিস আক্রান্ত হওয়া, আক্রমণের চেষ্টা করা, পত্রিকা ভবনকে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার জন্য উসকানি দেওয়া এবং প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের কার্যালয়ের সামনে গরু জবাই করে উগ্রগোষ্ঠীর জেয়াফৎ আয়োজন ও মব সৃষ্টি করাকে একধরনের 'সাধারণ নির্যাতন' হিসেবে বর্ণনা করেছেন মতিউর রহমান। তার মতে, এগুলো সরকারবহির্ভূত বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাজ।
সরকারের ঘোষিত ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিশ্লেষক, বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংশয়-সন্দেহ থাকলেও মতিউর রহমান আশাবাদী ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন হবে। জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রতারণা করেছে বলে দলটির অভিযোগ।
তবে মতিউর রহমান ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার বিষয়গুলোকে বর্তমান সরকারের 'সবচেয়ে দৃশ্যমান কাজ' হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি বলছেন, 'ধৈর্য ধরে এত দিন আলোচনা চালিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সংস্কার প্রস্তাবে একমত হওয়াকে আমি অগ্রগতি বলতে চাই।'
প্রকাশনায় আসার পর থেকে, বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলেও মতিউর রহমান নাগরিক সমাজের ব্যাপারে খুবই সোচ্চার ছিলেন। বিশেষ করে, তার সম্পাদিত প্রথম আলো সোচ্চার ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের আমল থেকে রহস্যজনকভাবে পত্রিকাটিতে নাগরিক সমাজের উপস্থিতি নেই। নাগরিক সমাজকে এখন এড়িয়ে চলছেন তিনি।
এ বিষয়ে মতামত জানতে প্রশ্ন করা হলে তিনি আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে জড়িয়ে কী বলতে চেয়েছেন, এর অর্থ উদ্ধার করা সাধারণ পাঠকদের পক্ষে অসম্ভব।
মতিউর রহমান গত ৪ঠা নভেম্বর পত্রিকাটির ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের ওই আয়োজনে প্রথম আলোর শুরুর কথা, এগিয়ে চলা, নানা সময়ের চ্যালেঞ্জসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন তিনি। সেখানেই তিনি এসব অভিমত ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানটির উপস্থাপনায় ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। অনুষ্ঠানের আলোচনা ঈষৎ সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত আকারে প্রথম আলোতে আজ শনিবার (১৫ই নভেম্বর) প্রকাশিত হয়েছে।
নেটিজেনদের অভিযোগ, প্রথম আলোই দেশের একমাত্র পত্রিকা, যারা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার জন্মদিনে তাকে নিয়ে লেখা দিয়ে পত্রিকার জ্যাকেট (বিশেষ পাতা) প্রকাশ করেছিল। দেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে যা আর কখনো হয়নি। কেন সেদিন প্রথম আলো এমন সংখ্যা প্রকাশ করেছিল, এ নিয়ে বাজারে মুখরোচক নানা কথা প্রচলিত আছে।
মতিউর রহমান চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠানে বলেন, সর্বত্রই আলোচনা। যার সঙ্গে দেখা হয়, তিনিই বলেন, ‘ভাই, নির্বাচন কি হবে?’ এ বিষয়ে সত্যিকারের অর্থে বলব যে আমি খুব ভীত নই। সংশয়বাদীদের মতো এটা নিয়ে খুব ভাবিনি। আমি ধরে নিয়েছি যে নির্বাচন হবে, হতে হবে। এ ছাড়া আমাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, সবচেয়ে দৃশ্যমান যে কাজটা তারা (সরকার) করেছে, সেটা হচ্ছে ঐকমত্য কমিশন গঠন করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রায় আট মাস ধরে, ৩৩টা দল, পরে ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেছে। তার মধ্যে পাঁচ, সাত, আটটি দল নিয়ে নানাভাবে, নানা দিক থেকে হয়তো মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আছে। অন্যরা তেমন কোনো শক্তি, সমর্থন, বা দাবি আদায়ের মতো জায়গায় ছিল না।
তার মতে, তারপরও কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে সাত-আট মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রকাশ্যে আলোচনা, যেটা টিভিতে দেখা যায়, রেডিওতে শোনা যায়, এটা কিন্তু একটা নতুন অভিজ্ঞতা। সেদিক থেকে বলব যে ধৈর্য ধরে এত দিন আলোচনা চালিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সংস্কার প্রস্তাবে একমত হওয়াকে আমি অগ্রগতি বলতে চাই।
মতিউর রহমান বলেন, আমরা এটা বলব না যে সব সময়, সব আমলে, সব সরকারের সময় আমরা সব সত্য কথা বলতে পেরেছি। বিশেষ করে, বিগত ১৬ বছর স্বৈরাচারী সরকারের আমলে আমরা অনেক সত্য কথা বলতে পারিনি। যতটুকু বলার চেষ্টা করেছি, তাতে আমাদের যথেষ্ট চাপের মুখে, বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে। আমাদের প্রচারসংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার বহু চেষ্টা হয়েছে। আমাদের সরকারের অনেক বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ব্যক্তি খাতের প্রায় ৫০টি কোম্পানির বিজ্ঞাপনও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, আমরা সত্য কথা বলার চেষ্টা করেছি; এবং সত্য বললে আপনি টিকবেন, আপনি চলতে পারবেন। আমাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে, কিছু এখনো রয়েছে। কোনো মামলায় কিন্তু আমাদের অপরাধী হিসেবে শাস্তি দিতে পারেনি; কারণ, আমাদের তথ্য, খবর, সংবাদ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। সে জন্যই বলি, আমরা সত্য কথা বলি। এখন আমরা বলছি, এখন প্রয়োজন ‘সত্যই সাহস’।
তিনি বলেন, আপনি যদি বর্তমান সরকারের সময়ের কথা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমরা বলব, এখনো আমাদের কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু বিবেচনায় নিতে হয়। কারণ, আপনি জানেন যে প্রথম আলো এই সময়কালেও সরকারবহির্ভূত বিভিন্ন গোষ্ঠীর ব্যক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের অফিস আক্রান্ত হয়েছে, আক্রমণের চেষ্টা করা হয়েছে। এটাকে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার জন্য উসকানি দেওয়া হয়েছে। এসব তো চলেছে। অর্থাৎ কখনোই কোনো দেশেই সংবাদপত্র সব কথা সব সময় বলতে পেরেছে, এটা বলা যায় না।
মতিউর রহমান বলেন, কোনো সময়ই কোনো সরকার কোনো অবস্থাতেই সংবাদপত্রশিল্পকে তারা বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেনি। তার ফলে আমাদের যে প্রাপ্য, আমাদের যে পাওনা, সেটাও আমরা পাই না। আমরা বিজ্ঞাপন পাই না, রেটও কম। আবার সে বিল আমরা পাই না। এমনকি নতুন নতুনভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। যে সরকার যখন আসে, তাদের মিত্র ও তাদের বন্ধুদের তারা এই বিজ্ঞাপনে বড় অংশ বা সিংহভাগ দিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, অন্যদের জন্য আর তেমন থাকে না। আমরা সেটা পাই না। অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে সেগুলো পেতে আমাদের বাধা দেওয়া হয়। একটা জটিল, কঠিন অবস্থার মধ্যে সংবাদপত্রশিল্প আছে। এখনো টিকে আছে, কিন্তু আগামীতে কী হবে, এটা বলা খুব মুশকিল। সে জন্যই হয়তো রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হলে, যদি বিনিয়োগ হয়; উন্নতি হয়, যদি অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা আসে, তাহলে কিছু আশা করতে পারি।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে যাত্রা শুরুর পর ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০০টির বেশি মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রথম আলোর সম্পাদক ও এর সাংবাদিকদের। এমনকী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও মামলা রুজু হয়েছে একটি। প্রায় সব সরকারের আমলেই পত্রিকাটি মামলার শিকার হয়।
প্রচার সংখ্যার বিচারে প্রথম আলো সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রায় সব সরকারের আমলেই বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের গত সরকার পত্রিকাটিতে সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করেনি। সরকারি বিজ্ঞাপনের রেট কম হওয়ায় প্রথম আলো নিজেই ঘোষণা দিয়ে তা ছাপানো বন্ধ করে দেয়।
খবরটি শেয়ার করুন