স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ।। ছবি: বিবিসি বাংলা
“এই দুই বছর আগেও সপ্তাহে এক-দুইবার তেলাপিয়া নাইলে পাঙ্গাস মাছ কিনতে পারতাম, ঐগুলার দাম তখন নাগালের মধ্যে ছিল। গত কয়মাস ধরে বাজারে গিয়ে ঐসব মাছের দিকে তাকাইতেই সাহস হয় না, অন্য মাছের কথা তো বাদই দিলাম,” আক্ষেপ করছিলেন রামপুরার বাসিন্দা গার্মেন্টস কর্মী হুসনা আক্তার।
তার মত ঢাকা শহরের অনেক নিম্ন আয়ের মানুষের মনোভাব একই রকম। ইলিশ বা রুই, কাতলার মত মাছ না কিনতে পারলেও সিলভার কার্প, তেলাপিয়া বা পাঙ্গাসের মত অপেক্ষাকৃত কম দামী মাছ ছিল নিম্ন আয়ের মানুষের প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস। কিন্তু সেসব মাছের দামও এখন এই জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে চলে গেছে।
মাছের দাম নিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের অভিযোগ থাকলেও মাছের উৎপাদনের দিক দিয়ে কিন্তু বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে উন্নতি করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও’র "দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২২" প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুক্ত জলাশয় বা স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশে মাছ উৎপাদনের পরিস্থিতি
বিশ্বে মোট উৎপন্ন স্বাদুপানির মাছের মধ্যে ১১ শতাংশ উৎপাদন করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ওপর রয়েছে চীন ও ভারত। তারা উৎপাদন করে যথাক্রমে ১৩ ও ১৬ ভাগ।
চাষের মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পঞ্চম থেকে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
মাছের দাম এখনো সবসময় নিম্নবিত্তের নাগালের মধ্যে থাকে না ।। ছবি: বিবিসি বাংলা
সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরেই বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। অর্থাৎ, প্রতি বছর দেশজ চাহিদার শতভাগ দেশীয় উৎপাদন দিয়ে পূরণ করার সক্ষমতা পেয়েছে সেসময় থেকে।
দেশের মোট জিডিপি’র প্রায় ২.৫% অবদান মৎস্য খাতের বলে উঠে এসেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে উৎপাদিত মাছের চেয়ে ৮৫ শতাংশ বেশি মাছ উৎপাদন হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছরে।
এই ১৫ বছরে মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬০ গ্রাম থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৬৮ গ্রাম।
তবে চাহিদার চেয়ে বেশি মাছ উৎপন্ন হলেও রপ্তানির হিসেবে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে নেই।
দু'হাজার একুশ-বাইশ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭৪,০০০ মেট্রিক টন মাছ রপ্তানি করে, যার মূল্য ছিল ৫,০০০ কোটি টাকারও বেশি।
তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। এই সময়ে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৭০,০০০ মেট্রিক টন এবং এই রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪,৭৯০ কোটি টাকা।
এছাড়া মিয়ানমার, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড থেকে বিভিন্ন রকম মাছ আমদানিও করে বাংলাদেশ।
মাছ রপ্তানিতে এখনো বিশ্বের শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে নেই বাংলাদেশ ।। ছবি: বিবিসি বাংলা
তবে উৎপাদনের দিক দিয়ে ক্রমাগত উন্নতি হতে থাকলেও বিভিন্ন কারণে এই উৎপাদনের সুফল মানুষ সরাসরি ভোগ করতে পারছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হাসিন জাহান বলছিলেন, “মাছের সহজলভ্যতা কিন্তু আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আগে পাঙ্গাস বা পাবদার মত মাছ চাষ হত না। এখন এই ধরণের মাছ অনেক জায়গায় চাষ হয়, ফলে বাজারে পাওয়াও যায় বেশি। আর এসব মাছের দাম মানুষের নাগালের মধ্যেও রয়েছে।”
মাছের খাবার তৈরির সক্ষমতা বৃদ্ধি, মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা কমানো ও বাজারে নজরদারি বাড়ানো হলে মাছের দাম সাধারণ মানুষের আরো নাগালের মধ্যে আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“মাছের খামার থেকে বাজারে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত মাছ নিয়ে আসার সময় দাম বেড়ে যায়। খামার থেকে বিক্রেতা পর্যন্ত এই মধ্যস্বত্তভোগীর সংখ্যা যত বাড়বে, মাছের দামও ক্রেতার জন্য তত বাড়বে।”
এছাড়া মাছের খাবার তৈরির ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারলেও খুচরা পর্যায়ে দাম কমবে বলে বলেন তিনি।
মাছের খাবার তৈরির সক্ষমতা বৃদ্ধি, মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা কমানো ও বাজারে নজরদারি বাড়ানো হলে মাছের দাম আরো নাগালের মধ্যে আসবে ।। ছবি: বিবিসি বাংলা
“মাছের ফিড যদি আমরা শতভাগ নিজেদের দেশে তৈরি করতে পারি তাহলে মাছ উৎপাদনের খরচ বেশ কিছুটা কমবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দামও কমবে।”
বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান মাছের ফিড তৈরি করে। কিন্তু বাণিজ্যিক পর্যায়ে ব্যবহার হওয়া মাছের ফিডের অনেকাংশই এখনো বিদেশ থেকে আমদানি হয়ে থাকে।
আর মধ্যস্বত্বভোগী বা ব্যবসায়ীদের চক্র যেন বাজারে প্রভাব খাটিয়ে দাম বাড়াতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে বাজারে পর্যবেক্ষণ ও সরকারি নজরদারি বাড়ানোও গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ মিজ হাসিন জাহান।
আরো পড়ুন: স্মার্ট মৎস্য সেক্টর গড়ে তোলাই এখন লক্ষ্য: রেজাউল করিম
এছাড়াও সময়মত বৃষ্টি না হলে সেচের পানি ব্যবহার করা, মাছের ওষুধের খরচ বৃদ্ধি ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণেও মাছের দাম বেড়েছে বলে বলছেন মাছ চাষ ও মাছের ব্যবসার সাথে জড়িতরা।
এম এইচ ডি/ আইকেজে