মাঠ ভরা বোরো ধান - ছবি সংগৃহীত
কাবেরী মৈত্রেয়
যেদিকে চোখ যায় কেবল সবুজ-হলুদ রঙের হাতছানি। মাঠের পর মাঠ ধান ক্ষেত, বাতাসে দোল খেয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে কৃষককে। ধান উৎপাদনে দেশে যে-কটি জেলা সমৃদ্ধ তার মধ্যে নওগাঁ অন্যতম। এখন এই জেলার যে গ্রামেই যান না কেন, মিলবে এমন দৃশ্য। কৃষক-কৃষাণীরা এখন মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছেন বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ে।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেলো, মাঝেমধ্যে লোডশেডিং, আর বৃষ্টির অভাবে সেচে পানির স্বল্পতা থাকলেও এ বছর এ অঞ্চলে জিরা, কাটারিভোগ, উফশী, ব্রি-২৮য়ের মতো জাতের ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এছাড়া পোকামাকড় ও রোগবালাইও তুলনামূলক কম ছিলো। এতে বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২৫ মণ ধান পাচ্ছেন তারা। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে শ্রমিকের অভাবে ধান মাড়াই কাঙ্ক্ষিত হারে করতে পারছেন না কৃষকরা। এরই মধ্যে বেড়ে গেছে শ্রমিকের দাম ।
কৃষি শ্রমিকের সংকট আর বর্ষার মৌসুম হওয়ায় কৃষকের ধানকাটা ও মাড়াই শেষমেষ কি অবস্থায় যাবে তা নিয়ে শংকিত এখন কৃষকরা। বাম্পার ফলন হলেও ঠিক কতোটা কৃষকের ঘরে উঠবে ধান, সে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় তারা। গেল বছরও দুযোর্গপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এ কারণে সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা তারচেয়ে অন্তত ৩৫ শতাংশ কম ধান পেয়েছে নওগাঁর কৃষি বিভাগ।
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, বাম্পার ফলন হলেও এবার গেল বছরের তুলনায় বেড়েছে ধান চাষের খরচ। সার ও কীট নাশকের দামের পাশাপাশি শ্রমিক সংকটে মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ বেড়েছে প্রায় ৬ টাকা। এ বছর প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ প্রায় ২৪ টাকা, যা গেল বছর ছিলো ১৮ টাকার মতো। সে হিসাবে স্থানীয় বাজারগুলোতে যে ধান বিক্রি হচ্ছে তার দামও বেড়েছে । প্রতি মণ জিরা ধান বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২৭০ টাকায় যা গেল বছরও ছিলো ১ হাজার ৫০ টাকা মণ হিসাবে। কেবল নওগাঁ নয়, এমন চিত্র প্রায় সারা দেশে। মাঠ ভর্তি বোরো ধানের বাম্পার ফলন কিন্তু সার ও কীটনাশকের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রমিক সংকটে বেড়েছে ধানের দাম।
বলে রাখা ভালো যে সারা বছর দেশে যে চালের চাহিদা তার ৫০ শতাংশেরও বেশি আসে বোরো থেকে। চলতি মৌসুমে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪৯ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর এর বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৫০ লাখ হেক্টর। যা সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। আবার বোরো ২ কোটি ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ তার বিপরীতেও সন্তোষজনক উৎপাদন আশা করছে সরকার।
কিন্তু এরই আশা ঠিক কতোটা পূরণ হবে সেটি নিয়ে এখন সংশয় । কেননা মে মাসে হাওরে ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস, এপ্রিলে দীর্ঘ সময়জুড়ে তীব্র দাবদাহ, সব মিলিয়ে বোরো ফলন ঠিক কতোটা ক্ষতিগ্রস্থ তার সঠিক তথ্য-উপাত্ত এখনো নেই।
কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরগুলোর এখন উচিত হবে মাঠ পর্যায়ে সেই খোজঁখবর-ই নেয়া। কেননা যে বিপুল সংখ্যক কৃষক বোরো চাষ করেছেন তাদের বেশিরভাগ ক্ষুদ্র-মাঝারি । ধারকর্জ করে আবাদ করেন। তাই বেশিদিন ফসল ধরে রাখতে অক্ষম তারা। অনেকে আবার বর্গাচাষী। মাঠে ধান নষ্ট হলেও তাদের ক্ষতি অসহনীয় হবে। তাই কৃষি বিভাগকে যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে এদের পাশে থাকতে হবে। ধান কাটাসহ মাড়াইয়ে কৃষক যাতে দুর্ভোগে না পড়ে সে জন্য কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয়ে আরো বেশি ভতুর্কি দিতে পারে সরকার কিংবা যে ভতুর্কি এখন মিলছে তা প্রকৃত কৃষকরা পাচ্ছেন কিনা সেটি খতিয়ে দেখতে পারে।
বাজার তো বটেই সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবে, দেশে বছর ব্যবধানে এখন প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ বেশি মোটা চালের দাম। আর সরু চালে এ বাড়তি দাম প্রায় ৬ শতাংশ। বোরো ধান বাড়তি দামে কিনে আবার মিলগুলোতে উৎপাদনেরও বাড়তি খরচ গণার অজুহাতে মিল মালিকরা বাড়িয়ে দিতে পারেন চালের দাম । যা দিন শেষে ভোগাবে নিম্ন ও মধ্য আয়ের ভোক্তাদের, এই মূল্যস্ফীতির চড়া সময়ে।
তাই সাধারণ ভোক্তাদের চাল কিনতে স্বস্তি দিতে হলে অবশ্যই ধান মাড়াই থেকে চাল উৎপাদন সব পর্যায়ে বাড়াতে সরকারের নজরদারি। কেবল তাই নয়, চালের উল্লেখযোগ্য মজুদের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ জরুরি। খোলা রাখতে হবে চাল আমদানির পথও। আমরা জানি, গেল মার্চ পর্যন্ত চাল আমদানি সহজ করতে সরকার প্রায় বিনাশুল্ক নীতি অবলম্বন করছিল। এর আওতায় আমদানি হওয়া উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাল এখনও পাইপলাইনে বলে জানা যাচ্ছে। এসব চাল বাজারে আসলেও, দেশের খুচরা বাজারে চালের দামের ওপর এর বড় কোনো প্রভাব পড়বে কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের গড়িমসি থাকলেও দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের খাবার নিশ্চিতে ভর্তুকি ও বিনামূল্যে চাল বিতরণ করে যেতে হবে। পাশাপাশি এদের রুজি-রোজগার বাড়ানোর দিকে মনোযোগ থাকলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হবে না।
কাবেরী মৈত্রেয়, সাংবাদিক।
খবরটি শেয়ার করুন