বুধবার, ৩রা জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৯শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘ডেঞ্জার জোন’ সিলেটের ডাউকি ফল্ট, বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা, প্রস্তুতি কতটুকু

বিশেষ প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০২:৪০ অপরাহ্ন, ১৬ই আগস্ট ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ হয়ে উঠেছে ‘ডাউকি ফল্ট’। বাংলাদেশের সিলেট ও ভারতের আসাম মিলিয়ে ‘ডাউকি চ্যুতি’ পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় তিনশ কিলোমিটার বিস্তৃত।  ঢাকায় গত সোমবার (১৪ আগস্ট) রাতে যে ভূমিকম্প হয়েছে সেটির উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের ভূগর্ভের ডাউকি চ্যুতি নামে পরিচিত ফাটল বরাবর। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। এই মাত্রা গত ২০ বছরে দেশের ভেতরে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। গত কয়েক বছরে এই চ্যুতিরেখায় বেশ কিছু ভূমিকম্প হয়েছে। এর ফলে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় মোট ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ এবং সিলেট জেলায় ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশই ছয়তলা বা তার চেয়ে বেশি। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো এবং এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

যে কোনও সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও বাংলাদেশে ভূমিকম্প মোকাবেলায় তেমন কোনও প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুরস্কের মতো বড় ভূমিকম্প বাংলাদেশে হলে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তারা বলছেন, রাজধানী ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে যে পরিমাণ বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে তাতে ভূমিকম্পে এসব ভবন ধসে পড়লে শহরগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। যার কারণে ব্যাহত হবে উদ্ধার কাজ।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেন, ন্যাশনাল অপারেশন সেন্টার নির্মাণের জন্য চীনের সাথে ২০১৬ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী, চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় এটি নির্মাণের কথা রয়েছে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে একটি জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে।

তবে এই কাজের গতি ধীর উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এই সেন্টারটি নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যেমন ধীরগতির, তেমনি চীনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও ধীরগতির। তাদেরকে বারবার পত্র দেয়ার পর তারা রেসপন্স করে একটু একটু করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ঘন জনবসতি এবং হাজার হাজার বহুতল ভবন যেগুলো কোন ধরনের বিল্ডিং কোড না মেনেই নির্মাণ করা হয়েছে।

সাধারণত রিখটার স্কেলে ৫–এর ওপরে গেলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প বলা হয়। এর নিচে হলে তাকে মৃদু কম্পন হিসেবে গণ্য করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে উৎপত্তি সবচেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ২০০৩ সালের ২৬ জুলাই। যার মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬। এ ছাড়া গত এক বছরে বাংলাদেশে ১৭টি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ভূমিকম্প ছিল ৫ মাত্রার বেশি। এর মধ্যে গত সোমবারের ভূমিকম্প ছাড়া বাকি দুটি ভূমিকম্পের একটি ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট হয়। যার মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ১। আর আরেকটি ভূমিকম্প হয় চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি। ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ২। এ ছাড়া ১৪টি ভূমিকম্পের মাত্রাই ছিল ৪ থেকে ৫–এর মধ্যে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার যে ভূমিকম্প অনুভূত হয় তার উৎস ছিল ঢাকা থেকে ২২৮ কিলোমিটার দূরে সিলেটের কানাইঘাট ও ভারতের আসাম সীমান্তের কাছে। ভূগর্ভের ১০ কিলোমিটার গভীরে এর উৎপত্তি। ভূমিকম্পটির কম্পন রাজধানীসহ সারাদেশে ভালোই অনুভূত হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান রুবায়েত কবির বলেন, সাধারণত দেশের ভেতরের উৎস থেকে যেসব ভূমিকম্প হয়, তা চার থেকে পাঁচ মাত্রার হয়ে থাকে। এতে মৃদু কম্পন ও কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হওয়া ছাড়া তেমন ক্ষয়ক্ষতি হতে দেখা যায় না। গত ২০ বছরে সাড়ে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে আমরা দেখিনি। সোমবারের ভূমিকম্পের উৎসস্থলটি ডাউকি চ্যুতি বরাবর। সেখানে ভূমিকম্প বাড়ছে। এটা ওই এলাকায় বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের হিসাবে, সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ও সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা। সিলেটকে বরাবরই ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রায়ই এখানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। গত দু’বছরে সিলেট অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট বেশ কয়েকটি ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। সিলেটের গোলাপগঞ্জ, ছাতক, বিশ্বনাথ, সিলেট সদর এবং ডাউকি ফল্ট জৈন্তাপুরে কয়েকটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল। ২০২১ সালে ১০ দিনের ব্যবধানে সিলেটে যে ১০ দফা ভূমিকম্প হয়েছে। এসব ভূমিকম্পের উৎপত্তি ছিল ডাউকি ফল্টে। এজন্য সিলেটের স্থানীয় এ ভূমিকম্প নিয়ে বিশেষজ্ঞরাও চিন্তিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত বড় ভূমিকম্পের আগে বা পরে এমন দফায় দফায় মৃদু কম্পন হতে পারে। ফলে ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট। আর সিলেট থেকে ঢাকার অবস্থান খুব বেশি দূরে নয়। সেখানে যদি ৬ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয় তাহলে এর বড় প্রভাব গোটা দেশেই।

বাংলাদেশের সিলেট ও ভারতের আসাম মিলিয়ে ডাউকি চ্যুতি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় তিনশ কিলোমিটার বিস্তৃত। এর আগে, ১৮৯৭ সালে ‘ডাউকি ফল্টে’ ৮ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পের উৎস ছিল ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে। সেসময় ভূমিকম্পে ভূমিকম্পে আহসান মঞ্জিলসহ ১০টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আই. কে. জে/

ভূমিকম্প ডাউকি ফল্ট প্রস্তুতি

খবরটি শেয়ার করুন