ছবি: সংগৃহীত
ফেসবুকে এখন 'সান্ডা'র ট্রেন্ড চলছে। ‘কফিলের ছেলে’ ও ‘সান্ডা’ শব্দ দুটি ভেসে বেড়াচ্ছে ফেসবুকের হোমপেজ-রিলসে। ‘কফিল’ শব্দটি দিয়ে বোঝায়, মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়োগকর্তাকে। তাদের ছেলেদের (বিশেষ করে ছোট ছেলেকে) ঘিরে এখন নানা রসিকতা ও আলোচনা চলছে। আর এ আলোচনার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সান্ডা নামক একটি প্রাণী। সান্ডার বিরিয়ানি নাকি কফিলের ছোট ছেলের খুব পছন্দ!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সান্ডা নামের প্রাণী নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এ প্রাণী নিয়ে অনেকে কৌতূহলী হয়ে নানা কথা বলছেন। অনেকে এ প্রাণীর তেলের উপকারিতার কথাও লিখছেন। আমাদের দেশের অনেকে বলে থাকেন, 'সান্ডার তেলে ডান্ডা শক্ত'। 'ডান্ডা' বলতে এখানে বুঝানো হয় পুরুষাঙ্গকে। অর্থাৎ, প্রচলিত আছে, সান্ডার তেল ব্যবহার করলে পুরুষাঙ্গের আকার বড় হয়। সেক্স করার সময় পুরুষাঙ্গ অনেক শক্ত হয়। যা যৌন মিলনের সময় জরুরি।
আসলেই কি এ প্রাণীর তেলের তথা ‘সান্ডার তেল’ এর কোনো উপকারিতা আছে? সান্ডা থেকে তৈরি নানা কবিরাজি ওষুধ নিয়ে উন্মুক্ত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সায়েন্স ডিরেক্ট-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে কিছু আলোচনা পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে, কাঁটাযুক্ত লেজবিশিষ্ট টিকটিকি ভারত ও পাকিস্তানে সান্ডা নামে পরিচিত। আয়ুর্বেদিক বা কবিরাজি ওষুধ তৈরিতে বিভিন্ন প্রাণীর দেহের অংশ ব্যবহারের প্রথা অনেক দেশে আছে।
তেমনি এ প্রাণীরও ওষুধি গুণ আছে বলে অনেকের ধারণা। এ বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন দেশে সান্ডার তেল সেবনের প্রচলন রয়েছে। সান্ডার চর্বি থেকে নিষ্কাশিত তেল যৌনশক্তি বৃদ্ধি, অস্থিসন্ধি ও পেশির ব্যথা উপশমকারী এবং রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি করে—এমন বিশ্বাসে পাকিস্তান, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। তবে এ তেলের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণাপত্রটিতে কিছুই উল্লেখ নেই।
সান্ডার তেলের বিষয়ে পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক দ্য ডনের ওয়েবসাইটে ২০১৩ সালের ২৩শে অক্টোবর একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দাব বা লেজে কাঁটাযুক্ত টিকটিকি থেকে আহরিত তেল যৌনশক্তি বৃদ্ধি, পেশি, অস্থিসন্ধির ব্যথাসহ বিভিন্ন রোগ নিরাময় করে বলে লোকজন বিশ্বাস করে। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া, পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে এ প্রাণী ব্যাপকভাবে শিকার করা হয়।
পাকিস্তানের ওয়াইল্ডলাইফ ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা ওয়াসিম আহমেদ সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, সান্ডার তেলের উপকারিতার কোনো সত্যতা মেলেনি। কারণ, এর চর্বি অন্যান্য সরীসৃপ প্রাণীর মতোই।
ট্রাফিক ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, লেজে কাঁটাযুক্ত টিকটিকির বিভিন্ন অংশ এবং এর থেকে তৈরি বিভিন্ন পণ্য বিভিন্ন রোগের উপশমকারী ওষুধ হিসেবে মালয়েশিয়ার উপদ্বীপগুলোতে বিক্রি হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে মালয়েশিয়ায় এসব পণ্য ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির সমস্যা, যৌন অক্ষমতাসহ অন্তত ২০ ধরনের রোগের দাওয়াই হিসেবে বিক্রি হয়ে আসছে। তবে এ গবেষণাপত্রে এসব ওষুধের কার্যকারিতার তথ্য পাওয়া যায়নি।
আমেরিকা-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ভাইস ওয়ার্ল্ড নিউজ-এর ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে পাকিস্তানের মুহাম্মদ নাসির নামে একজন সান্ডার তেল প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতার বক্তব্য পাওয়া যায়। তিনি দাবি করেন, ‘এ তেল পুরুষাঙ্গে মালিশ করলে তা পুরুষত্বহীনতা দূর করে। এ ছাড়া এটি লিঙ্গ লম্বা, মোটা ও শক্ত করে এবং দ্রুত বীর্যপাত রোধ করে।’
ইসলামাবাদভিত্তিক ইউরোলজিস্ট আসিম খান ভাইস ওয়ার্ল্ড নিউজকে জানান, তার কাছে আগে প্রায় ৬০ শতাংশ রোগী ভুলভাবে এ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করেছিল।
ফরিদ নামে একজন ক্রেতা ভাইস ওয়ার্ল্ড নিউজের প্রতিবেদককে জানান, তিনি পাঁচ বছর ধরে এ তেল ব্যবহার করছেন। এ তেল ব্যবহার শুরু করার আগে তিনি ও তার স্ত্রী গর্ভধারণের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার যৌন অক্ষমতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। বেশ কিছু বছর ধরে এ তেল ব্যবহারের পর একটি ছেলেসন্তান পেয়েছেন। তাই এ তেলে তার অগাধ আস্থা।
চিকিৎসকরা এমন তথ্যে সন্তুষ্ট নন। সান্ডার তেলের কার্যকারিতা ও নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে গবেষণা না থাকার কারণে চিকিৎসকরা এটির ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন।
ডা. আসিম খান বলেন, ‘এখন প্রমাণভিত্তিক ওষুধ সেবনের যুগ। এসব ওষুধ বাজারে বিক্রি শুরুর আগে সঠিকভাবে গবেষণা করা দরকার। এমন তেল মালিশের চিকিৎসাগুলোর সমস্যা হলো, আমাদের কাছে খুব বেশি তথ্য নেই। যদি তারা এ তেল একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ৫০০ ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে, এ ক্ষেত্রে এক মাস পরে তাদের কী পরিবর্তন আসে? তাদের কিডনি কেমন কাজ করে? লিভারের ওপর কী প্রভাব ফেলে? আমরা এসব জানি না।’
সান্ডার তেল মূলত যৌন রোগের দাওয়াই হিসেবে বিক্রি করা হয়। এ বিষয়ে ডা. আসিম বলেন, ‘যৌন অক্ষমতার কারণগুলো জটিল ও বিচিত্র। এর সঙ্গে জৈবিক, মানসিক ও জীবনযাত্রার বিভিন্ন কারণের সম্পর্ক রয়েছে। হরমোনজনিত সমস্যা, হৃদ্রোগ ও দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার অভ্যাস—আধুনিককালে এগুলো বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে যৌন অক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করছেন, ততক্ষণ এ ধরনের সমস্যার স্থায়ী সমাধান মিলবে না।'
তিনি বলেন, 'যদি কোনো পুরুষের দ্রুত বীর্যপাতের সমস্যা থাকে, তাহলে কিছু ভেষজ ও হাতুড়ে চিকিৎসার মাধ্যমে সাময়িকভাবে এর লক্ষণ থেকে মুক্তি মিলতে পারে। তবে যতক্ষণ না চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষা, হরমোন পরীক্ষা এবং আল্ট্রাসনোগ্রাম না করছেন, ততক্ষণ এ সমস্যার প্রকৃত চিকিৎসা সম্ভব নয়।’
এইচ.এস/
খবরটি শেয়ার করুন