সোমবার, ১লা সেপ্টেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৭ই ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** ‘নির্বাচন কমিশন সার্ভিস’ গঠনে সিইসির আশ্বাস *** তিন দলের তিন মত, ফেব্রুয়ারিতেই ভোট করতে অনড় সরকার *** চীন সফর শেষে দেশে ফিরলেন এনসিপির নেতারা *** মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতিকে ধারণ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে: হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ *** কেউ যদি নির্বাচনের বিকল্প নিয়ে ভাবে, সেটা হবে জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক: প্রধান উপদেষ্টা *** জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে আলোচনা হয়নি: বিএনপি *** ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ *** ট্রাম্পের শুল্কের যে প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের ১৫ হাজার গার্মেন্টসে *** বিস্ফোরণ-গুলি-ড্রোনের শব্দকে শ্রুতিমধুর সংগীতে রূপান্তর করছেন গাজার শিল্পী *** অশান্ত বিশ্বে সি–মোদির বন্ধুত্বের বার্তা

রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়: সম্ভাবনার সঙ্গে অনিশ্চয়তার দ্বন্দ্ব

এসএম শামীম

🕒 প্রকাশ: ০৬:২৯ অপরাহ্ন, ১০ই আগস্ট ২০২৫

#

২০২৫ সালের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। জুলাই সনদের ঘোষণা এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটলেও এখনো রয়ে গেছে নানা প্রশ্ন অনিশ্চয়তা।

গতকাল শনিবার (৯ই আগস্ট) জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জনপ্রিয় টিভি টকশোতৃতীয় মাত্রা’র সঞ্চালক জিল্লুর রহমান তার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল 'জিল্লুর রহমানে' প্রকাশিত বিশ্লেষণমূলক ভিডিওতে এসব কথা বলেন। আজ রোববার (১০ই আগস্ট) সকাল ১১টায় এই প্রতিবেদন লেখা পযর্ন্ত তার চ্যানেলে ওই ভিডিওটি দেখেছেন ৪০ হাজার দর্শক।

নির্বাচনের স্বস্তি, তবে শঙ্কাও রয়ে গেছে

জিল্লুর রহমান বলেন, একটা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর নির্বাচন হবে—এই খবরে যেমন স্বস্তি আছে, তেমনি নির্বাচনের পরিবেশ, বৈধতা এবং সব পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে তা হতাশার কারণও হতে পারে। তিনি বলেন, বিএনপি এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং বলা যায়, আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের পথে ফিরে আসছে। এটি এক অর্থে আন্দোলনের কৌশলগত সফলতা, আবার এক অর্থে বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার একটি কৌশলী ধাপ।

শরিকদের ভিন্ন সুর

জিল্লুর রহমান মনে করেন, আওয়ামী লীগ পতনের পর বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে কাঁধ মিলিয়ে যে দলগুলো সামনে উঠে এসেছে—জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ—তাদের প্রতিক্রিয়ায় এক ধরনের হতাশা স্পষ্ট। তারা এখনো নির্বাচন বর্জনের কথা বলছে না, তবে বলছে, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ এখনো তৈরি হয়নি। মাঠের প্রশাসন এখনো আগের সরকারের অনুগতদের দ্বারা প্রভাবিত।

জিল্লুর রহমান বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। এমন বাস্তবতায় তারা নির্বাচনে যেতে চাইলে বড় রকমের রাজনৈতিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাইছে। জুলাই সনদ ঘোষণার পর এই নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যারা আন্দোলন করেছে, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই হবে। আন্দোলন তো আসলে গোটা দেশের মানুষই করেছেন।

অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা

জিল্লুর রহমান বলেন, এসব দাবির পেছনে যেমন রাজনৈতিক কৌশল আছে, তেমনি আছে বাস্তব অভিজ্ঞতা। গত এক দশকে নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলোর কর্মীদের ওপর হামলা, গ্রেপ্তার, হয়রানি ছিল এক নিয়মিত চিত্র। তাই ২০২৫ সালের নির্বাচনের আগে তারা নিশ্চিত হতে চাইছে—এবারের পরিস্থিতি অতীতের মতো হবে না।

নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার প্রতীকী দিক নিয়ে বিতর্ক

জিল্লুর রহমান উল্লেখ করেন, নির্বাচন ঘোষণার তারিখ নিয়েও রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। জামায়াতসহ কিছু রাজনৈতিক দল মনে করে, ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থান দিবসে নির্বাচন ঘোষণার মাধ্যমে একটি প্রতীকী বার্তার গুরুত্ব কমে গেছে।

তাদের মতে, যদি ৫ই আগস্ট শুধু জুলাই সনদের ঘোষণা দেওয়া হতো, তাহলে ওই দিনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য আরও শক্ত হতো। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণাটি যদি ৮ই আগস্ট—অন্তর্বর্তী সরকারের বর্ষপূর্তির দিনে হতো—তবে তা আরও শোভন ও গ্রহণযোগ্য হতো।

জিল্লুর রহমান বলেন, এসব সূক্ষ্ম রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয়তো সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোড়ন তুলবে না, কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে বিভ্রান্তি

সাংবাদিক জিল্লুর রহমান বলেন, এই সূক্ষ্ম রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয়তো জনসাধারণের মধ্যে বড় আলোড়ন তুলবে না, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর পাশাপাশি, জুলাই সনদকে ঘিরে তৈরি হয়েছে মতপার্থক্য। কেউ চাইছে এই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করা হোক, কেউ চাইছে অধ্যাদেশ জারি হোক, আবার কেউ বলছে গণভোটের মাধ্যমে জনসমর্থন নেওয়া হোক।

কারণ, আগামী নির্বাচন এই সনদের ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হবে—এই নিশ্চয়তা রাজনৈতিক দলগুলো চাচ্ছে। না হলে নির্বাচনের পর নতুন সরকার এই সনদের গুরুত্ব খাটো করে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিএনপির পুনরাবির্ভাব

জিল্লুর রহমান বলেন, বিএনপির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা এখন দৃশ্যমানভাবে বাড়ছে। লন্ডনে তারেক রহমানের (দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কাতারের মন্ত্রী এবং আমেরিকা ও ব্রিটেনের কূটনীতিক, সংসদ সদস্য ও নীতিনির্ধারকেরা।

তিনি বলেন, প্রশ্ন একটাই—ক্ষমতায় গেলে বিএনপির অগ্রাধিকার কী হবে? সুশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, অর্থনীতি—সব বিষয়ে বিএনপি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। কূটনীতিকদের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার পরিকল্পনা।

জিল্লুর রহমান উল্লেখ করেন, এমন সময়ের কথা যখন কয়েক বছর আগেও পশ্চিমা কূটনীতিকরা তারেক রহমানের নাম উচ্চারণে সংকোচ বোধ করতেন।

আওয়ামী লীগের সংকট ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থান নিয়ে জিল্লুর রহমান বলেন, দলটি এখনো তাদের পতনকে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বলে ব্যাখ্যা করছে। তাদের কিছু নেতার দাবি, দেশি-বিদেশি শক্তি মিলে শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করেছে। এমনকি কেউ কেউ বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার বা বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগই ছিল এই ষড়যন্ত্রের মূল লক্ষ্য।

তবে জিল্লুর রহমান প্রশ্ন তোলেন, এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে এনে কি রাজনৈতিক পুনরাগমন সম্ভব? জনগণ কি ভুলে যাবে গত ১৫ বছরের দমন-পীড়ন, দুর্নীতি এবং ভোটের নামে তামাশাকে?

সাংগঠনিক দুর্বলতা ও বিভাজন

জিল্লুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা এখন অত্যন্ত দুর্বল। অধিকাংশ শীর্ষ নেতা বিদেশে, অনেকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত। দেশজুড়ে আত্মগোপনে থাকা নেতারা মাঠে সক্রিয় হতে পারছেন না। তিনি বলেন, এমনকি গোপালগঞ্জে সাময়িক প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরও সেখানে কঠোর ট্র্যাকডাউনের মুখে পড়েছে দলটি। দেশের অন্য কোথাও তারা উল্লেখযোগ্য সাংগঠনিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না।

তবুও আওয়ামী লীগ আশাবাদী, কারণ তারা মনে করে—অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু ব্যর্থতা, যেমন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং সংস্কারের বিলম্ব—জনগণকে আবার তাদের দিকে ফিরিয়ে আনতে পারে। জিল্লুর রহমান প্রশ্ন করেন, সেটা কি হবে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে, না কেবল কল্পনার আশ্রয়ে?

নেতৃত্ব ও কৃতিত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব

তিনি বলেন, আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়েও এখন দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। কে শহীদ, কে নেতৃত্ব দিয়েছে, কে মাঠে ছিল—এই নিয়ে ছাত্র সংগঠন, নতুন রাজনৈতিক দল এবং ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে টানাপড়েন চলছে। এর ফলে গত বছরের যে ঐক্য দেখা গিয়েছিল, তা এখন অনেকটাই জর্জরিত।

নির্বাচন ঘিরে প্রশ্নের পাহাড়

জিল্লুর রহমান বলেন, এই বিভক্তি, এই সন্দেহ, এই আস্থাহীনতার মধ্যেই এগিয়ে আসছে নির্বাচন। সরকার বলছে, নির্বাচন হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। বিএনপি বলছে, তারা নির্বাচন চায়। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বলছে, তারা অংশ নেবে—তবে শর্তসহ। আওয়ামী লীগ বলছে, তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে তা একপক্ষীয় হবে। অথচ অতীতে তারাই এমন নির্বাচন করেছে।

জিল্লুর রহমান বলেন, তারা যদি মাঠে ফিরতে না পারে, তাহলে এই বক্তব্যের তেমন ওজনও থাকে না। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সামনে এক সম্ভাবনাময় কিন্তু অনিশ্চয়তায় পূর্ণ রাজনৈতিক সময় আসছে। নির্বাচন হবে, তবে সেই নির্বাচন কি আদৌ একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেবে? নাকি পুরনো খেলা নতুন মুখে আবার শুরু হবে?

এবার কী ভিন্ন কিছু হবে?

জিল্লুর রহমান বলেন, দলতন্ত্রের পথ কখনোই মসৃণ ছিল না, কিন্তু অতীত থেকে যারা শিক্ষা নিয়েছেন, তারাই ভবিষ্যৎ গড়েন। এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পুরনো ধ্বংসস্তূপের ওপর ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়তে পারে কী না।

তিনি বলেন, জনগণ দীর্ঘদিন ধরে নিঃশব্দে সবকিছু দেখে এসেছেন। এবার কি তারা সত্যিকারের নির্বাচন দেখে আশ্বস্ত হবেন? এই প্রশ্নই এখন ‘মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন’।

জিল্লুর রহমান বলেন, কেমন নির্বাচন হবে? মানুষ কি ভোট দিতে পারবেন? উৎসবমুখর পরিবেশে একটি নির্বাচন কি সম্ভব? দেশের মানুষ কি মনে করবেন—তার পছন্দের প্রার্থী আছে, তার পছন্দের প্রতীক আছে, তার আদর্শ এই নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করছে?

নির্বাচন কি সংঘাতপূর্ণ হবে? বিজয় নিশ্চিত করতে কেউ কি আবার কলাগাছ দাঁড় করাবে? নাকি এবার চিন্তা হবে যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়ে ভবিষ্যৎ সরকার গঠন ও কার্যকর সংসদ গঠনের?

তিনি বলেন, নারীদের অংশগ্রহণ, তরুণদের অংশগ্রহণ, আদর্শিক বৈচিত্র্য—এসব বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলোকে সজাগ ও সক্রিয় হতে হবে।

জিল্লুর রহমান মনে করেন, এই নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলবে।

রাজনীতি জিল্লুর রহমান

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন