ছবি: সংগৃহীত
রবি হক
বুদ্ধপূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে গৌতম বুদ্ধের জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দের এ দিনে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন, ৫৮৮ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের এ দিনে তিনি সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন ও জগতে বুদ্ধ নামে খ্যাত হন এবং ৫৪৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এ দিনে তিনি মহা পরিনির্বাণ লাভ করেন। তার বুদ্ধত্ব লাভের মধ্য দিয়ে জগতে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হয়। সেজন্য দিনটি বুদ্ধপূর্ণিমা নামে খ্যাত।
ভারতের অন্তর্গত তদানীন্তন কপিলাবস্তু নগরীর শাক্যমুনি বংশের রাজা শুদ্ধোধন ও রানি মহামায়ার ঘরে এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন, যার নাম ছিল সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থ পৃথিবীর এ জাগতিক ভোগবিলাসে নিজেকে ভাসিয়ে দেননি। তিনি খুব ছোটবেলা থেকে চিন্তাশীল, পরোপকারী, দয়াবান, মানবতাবাদী, অহিংস, আত্মজিজ্ঞাসু, সত্যসন্ধানী একজন মানব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
মানুষের জীবনে এত দুঃখ-বেদনা, রোগ-শোক, জ্বরা-মৃত্যু, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা, বৈষম্য কেন- এসব নিয়ে তিনি ভাবতেন। তিনি নিজের চিন্তা, চেষ্টা ও উপলব্ধি দিয়ে মানবজীবন ও জগতের সব দুঃখের হেতু এবং মানুষের নিজের কৃতকর্মকে এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
গৌতম বুদ্ধ নানা ধরনের পথ পরিক্রমায়, ধ্যান-সাধনায় নিজের বিচার-বিবেচনা দিয়ে বুঝতে সক্ষম হন- এ জগৎ বস্তুত দুঃখময়। তিনি তার নতুন মত প্রচার শুরু করেন, কিন্তু তা মানা বা স্বীকার করার জন্য কারও সঙ্গে কোনো প্রকার যুদ্ধবিগ্রহ, হিংসা-বিদ্বেষ, এমনকি কোনো ধরনের জোর জবরদস্তি করেননি।
তিনি বলেন, মানুষের অতি ভোগ, অতি লোভ, অপ্রাপ্তিতে দুঃখ, হারানোতে দুঃখ, অতি আশাতে দুঃখ, যে প্রিয়জনের সান্নিধ্য একসময় আনন্দ দেয়, সেই প্রিয়জনের বিরহে সে আবার দুঃখ পায়। তিনি মানুষে-মানুষে ভালোবাসা আর মৈত্রীকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন।
গৌতম বুদ্ধ প্রাথমিকভাবে মাত্র পাঁচটি সরল সূত্রে তার চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। যা পঞ্চশীল নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে পৃথিবীতে অনেক মত, পথ ও পন্থার প্রদর্শক বা উদ্ভাবক সময়ে সময়ে আবির্ভূত হয়েছেন। তার ‘জীব হত্যা মহাপাপ’- এ কথার মধ্যে যে অন্তর্নিহিত বিষয়টি রয়েছে, তা হলো, সব প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শন।
অহিংসা পরম ধর্ম- এ কথার মাধ্যমে হিংসা বিদ্বেষ পরিত্যাগের কথা বলেছেন তিনি। জগতের সব প্রাণী সুখী হওয়ার কথা বলেছেন। এ অমিয় বাণীগুলো জগতের মানুষদের শুনিয়েছেন। গৌতম বুদ্ধ বারবার বলেছেন, মানুষের নিজের মনে মূলত ভালো বা মন্দের উৎপত্তি হয়। মানুষ যদি তার নিজের মন নামের এ বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সঠিকপথে পরিচালিত করতে পারে, তাহলে এ জগতের অনেক সমস্যা আর থাকবে না।
তিনি আরো বলেছিলেন, তার মত-পথ অনুসরণের ক্ষেত্রে এসো, দেখ, যাচাই-বাছাই করে যদি তোমার ভালো লাগে, তবে তা গ্রহণ করবে, না হলে নয়। তিনি কারো প্রতি তার মতকে চাপিয়ে দেননি।
‘বুদ্ধ’ ও ‘বৌদ্ধ’ শব্দ নিয়ে অনেকে বিভ্রান্ত হন। ‘বুদ্ধ’ বল ও জ্ঞানী বুঝায়। ‘বৌদ্ধ’ অর্থে সাধারণত বুদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বলা হয়। বুদ্ধ নির্দেশিত নীতির ওপর ধর্ম অনুসরণ করে তার জ্ঞান সাধনায় রত থেকে অনুকরণ, অনুশীলন ও অনুধাবন করেন—তারা হলেন বৌদ্ধ।
বৌদ্ধধর্ম গুরুরা বলেন, জন্মসূত্রে কেউ বৌদ্ধ হন না, কর্মসূত্রেই বৌদ্ধ। বৌদ্ধ একটি সমষ্টিবাচক শব্দ—এ শব্দ দ্বারা একটি পরিবার, সমাজ, সম্প্রদায় ও জাতি বোঝায়। বৌদ্ধ জাতিগত অর্থে নয়, জ্ঞান আহরণ অর্থে বোঝায়। বৈশাখী পূর্ণিমা বা বুদ্ধপূর্ণিমার তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য অপরিসীম।
ভগবান গৌতম বুদ্ধ তার অন্তিমকালে বলেছিলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, তোমাদের পুনঃ বলছি, সংস্কার ধর্মগুলো একান্ত ক্ষয়শীল, তোমরা অপ্রমত্ত হয়ে স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন করো।’ এটা বুদ্ধের অন্তিম বাণী। এ মহান পবিত্র দিনে বৌদ্ধ নরনারীরা দান, ধর্মালোচনা, শীল আচরণ ও ধ্যান-সাধনা একাগ্রচিত্তে সম্পাদন করে থাকেন।
এইচ.এস/