দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা এবং তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ—এই বিষয়গুলো নিয়ে চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় টকশো ‘তৃতীয় মাত্রা’-তে বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্য করেছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও দ্য নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর।
গতকাল শুক্রবার (২২শে আগস্ট) টকশোর আলোচিত পর্বটি ‘তৃতীয় মাত্রা’র নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়। আজ শনিবার (২৩শে আগস্ট) দুপুর ২টা পর্যন্ত ভিডিওটি ২২ হাজারের বেশি বার দেখা হয়েছে।
আলোচনায় নূরুল কবীর বলেন, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ এমন একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন জুগিয়েছে, যারা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে বরং তা যুক্তির মাধ্যমে সমাজে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে দেড়শ’ অভিযোগ আনা সম্ভব, আইন অনুযায়ী বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে, যদি তা প্রমাণসাপেক্ষ হয়। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা দায়ের করা—যার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের কোনো সম্পৃক্ততাই নেই—তা কোন যুক্তিতে, কোন আইনে, কোন বিবেকে করা সম্ভব, সেটিই প্রশ্ন।
তিনি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আগের সরকারের আমলে এই মামলায় কোনো অগ্রগতি হয়নি, অথচ এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে হত্যার মামলা দেওয়া হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, কিছু উপদেষ্টাকেও তিনি ফিসফিস করে বলতে শুনেছেন, ‘এই মামলাগুলো আমরা দিইনি, অন্য কেউ দিয়েছে, বিএনপি দিয়েছে—আমরা করবই বা কী?’ তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এই দায় সরকার নিচ্ছে, না অস্বীকার করছে? সরকারের পক্ষ থেকেই আবার বলা হয়েছে, এসব মামলার বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।
বিচার ব্যবস্থার প্রসঙ্গে এসে তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিষয়ে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত মামলায় তার আদেশ, রায় ও পর্যবেক্ষণের মধ্যে বড় ধরনের অসঙ্গতি ছিল, যার ফলে দেশ একটি নতুন রাজনৈতিক সংকটে পড়েছিল। তার বিরুদ্ধে রায় জালিয়াতি ও দুর্নীতির মামলা হয়েছে—যদি প্রমাণ হয়, তবে তিনি আইনের আওতায় আসতে পারেন। কিন্তু একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করে গ্রেপ্তার করার মধ্য দিয়ে এই সরকার বিচারপ্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা নিজেরাই ধ্বংস করছে।
আলোচনায় তিনি বলেন, ২০২৪ সালের গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরা এখন ‘এনসিপি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। এই তরুণদের অনেক বন্ধুই বর্তমানে সরকারের অংশ, যাদের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস এনসিপির প্রতি যে নৈকট্য প্রকাশ করেছেন, তা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি করেননি। ফলে যারা নির্বাচন করবেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং ক্ষমতায় যাবেন, তাদের ভেতর থেকে এই বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে বা ভবিষ্যতেও হতে পারে—এটি একটি সমস্যার জন্ম দিতে পারে।
তবে তিনি বলেন, এ তরুণরা ইতিমধ্যে অনেক আত্মঘাতী এবং স্বার্থবিরোধী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা যদি ভবিষ্যতে নতুন করে এমন কোনো কর্মকাণ্ডে না জড়ান এবং তাদের বন্ধু-সহকর্মী যারা মন্ত্রী আছেন, তারা যদি নির্বাচনে অংশ নিতে চান, তবে নির্বাচনের বহু আগেই তাদের সরকার থেকে পদত্যাগ করা উচিত।
বাংলাদেশে জরিপ সংস্কৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিষয়ক জরিপে এখনো মানুষ স্পষ্ট করে কথা বলে না। কারণ, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষকে এমন একটি বাস্তবতায় বসবাস করতে বাধ্য করে, যেখানে তারা জরিপকারীকে অবিশ্বাস না করলেও আশঙ্কা থাকে—তাদের মতামত ফাঁস হলে তারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে পারেন। এটি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতায়ই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এখনো পরিপক্ব হয়নি। ফলে, এ ধরনের জরিপের ফলাফলকে পুরোপুরি বস্তুনিষ্ঠ বলা কঠিন।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত জরিপের ফলাফল প্রায়শই নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে মিল খায় না, যার পেছনে বড় কারণ হলো—নিরাপত্তার অভাব। তারপরও যদি ধরে নেওয়া হয়, জরিপটি বস্তুনিষ্ঠ, তাহলে দেখা যাচ্ছে—আগে ছিল ৩৮ শতাংশ, যা এখন বেড়ে ৪৮ শতাংশ হয়েছে। এর মানে, মানুষ এখনো সংশয়ে আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে, চাঁদাবাজি, দখলবাজির বিরুদ্ধে কেবল কথায় নয়, বাস্তবেও ব্যবস্থা নেওয়া।
তার মতে, যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজের কর্মীদের আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারে না, তারা জনগণের আনুগত্য আশা করলে তা হবে আত্মপ্রবঞ্চনা। কাজেই দায়িত্বশীল নেতৃত্ব ও দলীয় শৃঙ্খলা ছাড়া গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গঠন সম্ভব নয়।
খবরটি শেয়ার করুন