বুড়িগঙ্গা এখন পরিণত হয়েছে দূষণের নদীতে : ছবি - সংগৃহীত
ঢাকার চারপাশে অবস্থিত নদীগুলোই হচ্ছে রাজধানীর প্রাণ। ঢাকার জনপদকে সুরক্ষিত নাগরিক সভ্যতা হিসেবে গড়ে তোলার মূলে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অথচ মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো এখন রাজধানীবাসীর কাছে অস্বস্তিকর হয়ে ওঠেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নে এসব নদীর পানি স্বাভাবিক গুণাগুণ হারিয়ে বিষাক্ত হয়েছে। সেই সাথে অবাধে নদী ভরাট করে নানা ধরনের স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। ২০০৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ঢাকার নদীগুলোকে রক্ষা ও উদ্ধারের নির্দেশ জারি করেছিলেন। এরপর বুড়িগঙ্গা পুনরুদ্ধার ও রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে বেশ কিছু উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু একটা সময় থমকে যায়। বুড়িগঙ্গা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। এছাড়া ২০১৯ সালে আদি বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধারে বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্যোগে অবৈধ স্থাপনা অপসারণের উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে উদ্যোগ অব্যাহত না রাখায় সাফল্য ধরে রাখা যায়নি।
ঢাকার পানি দূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- গার্মেন্টস শিল্প, চামড়া শিল্প, ঔষধ শিল্প ও রাসায়নিক কারখানা। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতে টঙ্গী, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, তারাবো, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ইপিজেড ও ঘোড়াশাল কারখানা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬০-৭০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য এসে পড়ছে।
ঢাকার চারপাশের চার নদীতে ৬৩১টি পয়েন্ট দিয়ে দূষিত পানি যাচ্ছে। এর মধ্যে ২৫৮টি পয়েন্ট দিয়ে গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্প বর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। এছাড়া তুরাগ নদীতে ২৬৯টি পয়েন্ট, বালু নদীতে ১০৪টি পয়েন্ট দিয়ে দূষিত পানি যাচ্ছে। এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পয়েন্টগুলো সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসা তৈরি করেছে।
নদী দূষণের আরেকটি কারণ হলো অবৈধভাবে নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণ। শুধু রাজধানীর ভেতর খাল, জলাশয় ও নিম্নভূমি দখল হয়েছে ১০ হাজার ২৪৫ হেক্টর। এছাড়া রাজধানীর ৪৩টি খালের মধ্যে ১৭টির হদিস নেই। ২৬টি আছে শুধু তালিকায়, বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। এর মধ্যে ৫টি রয়েছে ব্যক্তি মালিকানায়। ৩৫টি সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। ১৩টি খালের প্রস্থ ১০ ফুটের বেশি নেই। এসব বর্জ্যের ৬০ ভাগই ট্যানারি ও স্যুয়ারেজের, ৩০ ভাগ বিভিন্ন শিল্প-কারখানার এবং বাকি ১০ অন্যান্য উৎস হতে। রাজধানী ঘিরে প্রায় তিন লাখ শিল্প কারখানা আছে। যার শতকরা নিরানব্বই ভাগের তরল বর্জ্যের শোধনাগার নেই।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার প্রতি লিটার পানিতে প্রায় দশমিক ৪৮ মিলিগ্রাম ক্রোমিয়াম রয়েছে। অথচ পানিতে ক্রোনিয়ামের মাত্রা দশমিক ৫০ মিলিগ্রাম হলে মানুষের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি শুধু বুড়িগঙ্গার ক্ষেত্রে নয়, প্রতিটি নদীরই একই অবস্থা। অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএ’র জরিপে বলা হয়েছে, পলিথিন, শিল্প-কারখানা এবং মানববর্জ্যের কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে প্রায় ১২ ফুট স্তর জমা পড়েছে। যা প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে। এগুলো সরানো হচ্ছে না বলে পানি দূষণের মাত্রা দিনদিন বাড়ছে।
আগে বলা হতো পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু বর্তমানে সুপেয় বা বিশুদ্ধ পানির নাম জীবন। কিন্তু দিনদিন সুপেয় পানির বড়ই অভাব দেখা যাচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসা পানি শোধনাগারের দায়িত্বে। কিন্তু দেখা যায়, অনেক সময় এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানের উপর দায় চাপিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। এটা মোটেও কাম্য নয়। ঢাকার নদী দূষণ রোধ করতে হলে সমন্বিত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নদী দূষণে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। শিল্পকারখানার বর্জ্য শোধনাগার তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দোষী সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
আই.কে.জে/