ছবি - সংগৃহীত
১০ই ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৫০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ।’ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে,‘জন্মগতভাবে সকল মানুষ স্বাধীন এবং সমান সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী।’ প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী খুব ঘটা করে দিবসটি পালিত হয়। হিউম্যান রাইটস বা মানবাধিকার শব্দটি বহুল প্রচারিত হলেও আজকের দিনে বিশ্বের অনেক স্থানেই মানবাধিকার লজ্জাজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলা হলেও জনগণের স্বীকৃত অধিকারগুলো বারবার হরণ এবং কোথাও কোথাও নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হচ্ছে। শক্তিশালী দেশের সাথে কম শক্তিশালী দেশ, শক্তিশালী সম্প্রাদায়ের হাতে কম শক্তিশালী সম্প্রদায় কিংবা ধনীর হাতে গরীব মার খাচ্ছে, তাদেরকে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এখন অনেক জায়গায় মানবাধিকার উপহাসের বস্তুতে পরিণত হয়েছে বললেও ভুল হবে না।
মানবাধিকারের কথা বলতে গেলে ১২১৫ সালে সম্পাদিত ম্যাগনাকার্টা, সপ্তদশ শতকে স্বাক্ষরিত পিটিশন অব রাইটস, বিল অব রাইটস, খিষ্ট্রপূর্বাব্দকালের প্রথম মানবাধিকার সনদ সাইরাস সিলিন্ডার প্রভৃতি প্রসঙ্গ সামনে আসে।
লিও তলস্তয় বলেছেন,‘জীবনের একমাত্র অর্থ মানবতার সেবা করা’—এই আহ্বানের সদুত্তর কি আমাদের কাছে আছে? আমরা কি বলতে পারি বিশ্বে কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে না? বর্তমান বিশ্বে বেশ কয়েক বছর ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আইনের শাসনের অধিক ব্যত্যয় লক্ষণীয়, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের জন্য দায়ী। বিশ্বব্যবস্থার এক ক্রান্তিলগ্নে ও বিশৃঙ্খল মুহূর্তে বড় বড় রাষ্ট্রগুলোকে মনে হচ্ছে অমানবিক হয়ে উঠছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গোটা মধ্যপ্রাচ্য অশান্তির আগুনে জ্বলছে। কোথাও কোথাও মানবতার কবর রচিত হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বের অনেক জায়গায় ছোট-বড় সংঘাত-সংকট চলছে। মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই সকল সংকটের যেন কোনো সুরাহা নেই! যুদ্ধের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ও বাস্তুচ্যুত হওযার ঘটনার মধ্য দিয়ে বারবার মানবতার পরাজয় ঘটছে, অথচ এটা দেখার কেউ নেই।
প্রকৃত অর্থে বিশ্ব মোড়লরা যত মানবাধিকারের কথা বলুক, এখনো বিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো নাজুক। এই সকল দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সব সময়ই উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক সন্ত্রাস, উগ্র মৌলবাদ, ধর্মীয় বিভাজনের কারণে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানমূলক পরিবেশ বিদ্যমান থাকে না। যার কারণে মারাত্মকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
তিব্বতের ধর্মীয় গুরু দালাই লামার ভাষায়,‘বিশ্ব এই নেতার, সেই নেতার কিংবা সেই রাজা বা রাজপুত্র বা কোনো ধর্মীয় নেতার নয়; বরং পৃথিবী হলো একমাত্র মানবতার।’ এটাই আসল কথা। মানুষ জন্মগ্রহণই করে মানবাধিকারের পতাকা হাতে নিয়ে। সেখানে একজন আরেকজনকে অধিকারবঞ্চিত করার সুযোগ পাবে কেন?
বাংলাদেশের সব সরকারের আমলেই কম-বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এ দেশে উল্লেখযোগ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো হলো-বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা, নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটক, রাজনৈতিক বন্দী বা ভিন্ন মতাবলম্বীদের আটক, মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় স্বেচ্ছাচারমূলক বা বেআইনি হস্তক্ষেপ, কারও ব্যক্তিগত অপরাধের অভিযোগে তার পরিবারের সদস্যদের হেনস্তা করা, মত প্রকাশে বাধা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা, সাংবাদিকদের ভয়ভীতি দেখানো কিংবা অন্যায্যভাবে গ্রেফতার, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ ও সংগঠন করার অধিকারে হস্তক্ষেপ, অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা, সরকারি খাতে গুরুতর দুর্নীতি, লিঙ্গ ভিত্তিক ব্যাপক সহিংসতা (পারিবারিক ও ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, যৌন নির্যাতন, কর্মক্ষেত্রে নির্যাতন, শিশু-বাল্যবিবাহ, জোরপূর্বক বিয়ে এবং এমন সহিংসতার অন্যান্য ধরন); শিশুশ্রমের নিকৃষ্ট ধরনের উপস্থিতি; জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকিসহ বিভিন্ন অপরাধ; স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন ও কর্মীদের সংগঠনের স্বাধীনতার ওপর উল্লেখযোগ্য বিধিনিষেধ।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার একে অপরের পরিপূরক। একটি অপরটিকে অধিকতর সমৃদ্ধ করে তোলে। গণতন্ত্র ছাড়া মানবাধিকার যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না। তথাপিও উন্নত বিশ্বের বহু গণতান্ত্রিক দেশে মানবাধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
আই.কে.জে/