সোমবার, ১লা জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৭ই আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধানের দামে খুশি হাওরের কৃষক

নিজস্ব প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ১১:৩৬ পূর্বাহ্ন, ২৮শে এপ্রিল ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

ব্রি-২৮, ব্রি-২৯ চিকন ও শুকনা ধান ১,০০০ থেকে ১,১৫০ টাকা পর্যন্ত দামে মাঠ থেকেই কিনে নিচ্ছেন পাইকাররা। বৈশাখের শুরু থেকে বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে ধান কাটা শুরু হলেও মোকামে এখনও পুরোদমে বেচাকেনা শুরু হয়নি।

দেনা করে বোরো ধান করা হাওরের কিছু ছোট কৃষক প্রয়োজনের তাগিদে অল্প করে ধান বিক্রি করছেন বাড়িতে রেখেই। নেত্রকোণায় দামও ভালো মিলেছে। তবে শেষ সময়ে ব্লাস্ট রোগের কারণে চিটা হওয়ায় সুনামগঞ্জে ধানের দাম কিছু কম।

ক্ষেত্রবিশেষে ব্রি-২৮, ব্রি-২৯ চিকন ধান ১০০০ হাজার থেকে ১১৫০ টাকা দামে মাঠ থেকেই কিনে নিচ্ছেন পাইকাররা। আর মোটা ধান ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মধ্যে। তবে ব্লাস্টের কারণে চিটা হয়ে যাওয়া ধানের দাম তুলনামূলক কম; সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার কৃষক, পাইকার, চালকল ব্যবসায়ী ও কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। হাওরের খলায়-খলায় এখন ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও সিদ্ধ করার কাজ পুরোদমে চলছে। ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক-কৃষাণীরা।

পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই জলভাণ্ডারের নিচু জমি দেশের খাদ্যশস্যের বড় জোগানদার। এই জমির দিকে সারা বছর তাকিয়ে থাকে হাওর অধ্যুষিত সাত জেলার কৃষক। তবে সবচেয়ে বেশি ধান হয় নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জ জেলায়। হাওরের জমির পুরোটাই এক ফসলি। এই ফসলের আয় থেকেই কৃষক সারা বছরের খাওয়া-পরা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, সামাজিক অনুষ্ঠান– সবকিছু চালায়।

তাই ফসল কাটার সময় হলে পরিবারের বাইরে থাকা সদস্যরাও বাড়ি ফিরে আসেন। দিনে ধান কাটা, শুকানো আর রাতভর উঠানে গৃহিণীরা ধান সিদ্ধ করেন। বাড়ি ভর্তি থাকে ‘ভাগালো’তে (বাইরে থেকে আসা শ্রমিক)। বলা হয়, ধান কাটা বা ‘দাওয়ামারি’র এই সময়ে হাওর ঘুমায় না।

এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় হাওরের ধান ছিল শুকনো। সরকারি হিসাবে, গত সোমবার পর্যন্ত সিলেটে ৫৫ শতাংশ, মৌলভীবাজারে ৭০ শতাংশ, হবিগঞ্জে ৬৭ শতাংশ, সুনামগঞ্জে ৭৩ শতাংশ, কিশোরগঞ্জে ৫৮ শতাংশ, নেত্রকোণায় ৭৭ শতাংশ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬৭ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে।

হাওরভুক্ত সাত জেলার হাওরে এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। আর হাওর ও হাওরের বাইরে উঁচু জমি মিলে মোট বোরো আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ টন চাল। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, বোরো মৌসুমে হাওরাঞ্চল দেশের ২০ শতাংশের মত চালের জোগান দেয়।

নেত্রকোণায় হাওরাঞ্চলের কৃষকদের অনেকে ধান মাঠে রেখেই পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন। আবার কেউ রোদ থাকায় শুকিয়ে পাইকারদের কাছে ধান বিক্রি করছেন। ভেজা ধান ৮০০ থেকে ৮৩০ টাকা আর শুকনো ধান ১১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের কৃষক জীবনি মিয়া শুকনো ব্রি-২৮ ধান পাইকারের কাছে বিক্রি করেছেন ২০০ মণ। বাড়ির সামনে খলা থেকে এই ধান পাইকাররা কিনে নিয়েছেন। প্রতি মণের দাম মিলেছে ১১৫০ টাকা করে।

তিনি বলেন, “এই দাম মোটামুটি পুষিয়ে যাচ্ছে। আমার যে ধান হয়, তা বাড়িতে রাখার সুযোগ নেই। তাই বিক্রি করতে হয়। কিছুদিন রেখে বেচতে পারলে আরও ভাল দাম পাইতাম। তাছাড়া গিরস্থি করতে কিছু ঋণও করছিলাম। এই ঋণ তো এখন দেওন লাগব।“

কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার কৃষক হারুন অর রশিদ ভুঁইয়া। তিনি খালিয়াজুরীর হাওরের জমিতে বোরোর আবাদ করেছিলেন। ধানও কেটেছেন। ২১ এপ্রিল ব্রি-২৮ শুকনো ধান বেচেছেন ৫০০ মণ।

হারুন বলেন, “পাইকারের কাছে ১১৪০ টাকা মণ দরে বেচলাম ধান।” খালিয়াজুরী সদরের কৃষক মনির হোসেন পাইকারের কাছে ব্রি-২৮ শুকনো ধান বেচেছেন ১১৪৫ টাকা মণ দরে। তার ভাষ্য, “দাম তো মোটামুটি ভালোই পাইছি।” ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ব্যবসায়ী গোলাম আলী প্রতি বছর খালিয়াজুরী হাওরে আসেন ধান কিনতে। এবারও তিনি এসেছেন এবং কিছু ধান কিনেছেন।

গোলাম আলী বলেন, চিকন ভেজা ধান তিনি ৯৭০ থেকে ৯৮০ টাকা মণ দরে কিনছেন। মোটা ধানে ৮২০ থেকে ৮৩০ টাকা দিচ্ছেন। শুকনো চিকন ধান কিনছেন ১১৪০ থেকে ১১৫০ টাকা করে। আর মোটা শুকনো ৯৫০ টাকা করে নিচ্ছেন।

এই ব্যবসায়ী জানান, তারা এসব ধান সাধারণত আশুগঞ্জ বাজারের মোকামে নিয়ে বিক্রি করেন। মোকাম থেকে ধান যায় চালকলে। অনেক ব্যবসায়ীর নিজেরই চালকল আছে। আবার কোনো কোনো চালকল মালিক মোকাম থেকে ধান কিনে নেন। পরে সেগুলো সরকারের গুদামে যায়। এর বাইরে কিছু ধান কৃষকরা সরাসরি গুদামেও দেন।

তবে এখনও বড় মোকামগুলোতে ধান ওঠেনি। হাওর অঞ্চলের ধানের বড় মোকাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নৌবন্দরের বাজার। এখানে নৌকায় করে ধান আনতে সুবিধা বেশি। পাইকারি ব্যবসায়ীরা ছাড়াও হাওরের বড় কৃষকরা এখানে নৌকায় করে ধান এনে সরাসরি বিক্রি করেন। ফলে মোকাম জমতে একটু সময় লাগে; বিশেষত পানি না এলে নৌকা চলতে পারে না।

আশুগঞ্জ মোকামের ব্যবসায়ী ও আশুগঞ্জ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হেলাল সিকদার বলেন, “ঈদের আগে তো ধান আসে নাই। এখন একটু একটু আসা শুরু করছে। আমরা কিনছি। তবে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। হাওরে তো কাটা চলছে।”

বাংলাদেশ মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এইচ আর খান পাঠান সাকি বলেন, “ধান কেনা শুরু হয়েছে। তবে ঈদের পরে পুরোদমে নতুন বোরো ধান কেনা শুরু হবে। চাল কলগুলো এই ধান কিনবে। ধানের দাম দিনে দিনে বাড়বে। কৃষক ভাইয়েরা আরও দাম পাবেন।“

ধান উৎপাদনে ব্যয়ের সঙ্গে মিলিয়ে এবার মোটুমুটি লাভ থাকছে বলে ধারণা দিলেন খালিয়াজুরী সদরের কৃষক শফিকুল ইসলাম তালুকদার।

তিনি বলেন, “একটা জমি আছে ১৭ কাঠার। সেই জমিতে বোরো আবাদ করতে বীজ, রোপণ, সার, সেচ বাবদ ২৫ হাজার টাকার মত খরচ হইছে। এবার কাঠাপিছু শুকনো ধানের হিসেবেই অন্তত পাঁচ-সাড়ে পাঁচ মণ ধান হইছে। বছর বালা হওয়ায় ফলনও বালা হইছে। এই জমিতে ৯৬ মণ ধান পাইছি।”

“আমরা এই ধান ১০০০ টাকা দরে বিক্রি করছি। এখন পর্যন্ত ১০০ মণ ধান বিক্রি করছি। এইবার বোরো আবাদে বালা লাভ হইছে। কাঠাপ্রতি গড়ে ১৫০০ টাকা খরচ হয়। ধরেন, ধানের দাম হয় প্রায় ৬০০০ টাকা। তাতে কাঠাপ্রতি সাড়ে চার হাজার টাকা লাভ হচ্ছে।”

শফিকুল বলেন, “যাদের জমি টানে, তাদের খরচ বেশি। তাদের সেচ, সার বেশি দিতে হয়। তাদের অন্তত কাঠাপ্রতি ১৮০০ টাকা খরচ আছে।” তবে সুনামগঞ্জের কৃষকরা ধানের দাম নিয়ে বিশেষ খুশি না। তাদের কিছু ধান ব্লাস্টের কারণে নষ্ট হয়েছে, কিছু ধান চিটা হয়েছে। তারা প্রতি মণে দাম পাচ্ছেন ৯০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা।

শাল্লা উপজেলার চাকুয়া গ্রামের কৃষক প্রীতম দাস বলেন, “হাওরের কৃষকের হাত এখন খালি। তাই সংসার চালাতে সস্তায় ধান বিক্রি করছেন তারা। আমাদের এলাকায় ৯০০ টাকায় ধান বিক্রি হচ্ছে।”

ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এবং এলাকার বড় কৃষক আমানুর রাজা চৌধুরী বলেন, চৈত্র মাস থেকেই কৃষক অভাবে থাকে। তাই সংসারের চাহিদা মিটাতে আগাম বাজারে প্রচলিত মূল্যের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করে দেন তারা। এবার ভালো ফলন হলেও দাম কম। “মাত্র ৯০০ থেকে ১০০০ হাজার টাকায় ধান বিক্রি করছেন কৃষক। এতে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।“

দিরাই উপজেলা সরমঙ্গল ইউনিয়নের চিতলিয়া গ্রামের কৃষক সত্যদ্বীপ দাস এবার আট কিয়ার (প্রায় আড়াইশ শতাংশ) জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। তিনি ধান পেয়েছেন প্রায় দেড়শ মণ। তবে তিনি এখনও জমির সব ধান কেটে শেষ করেননি। বেশিরভাগ কেটেছেন। ধান শুকিয়ে ঘরে রেখেছেন। খোরাকি রেখে বাকিটা বিক্রি করবেন বলে আশা করছেন।

আরো পড়ুন: হাওরে ৭০ শতাংশ বোরো ধান কাটা হয়েছে : কৃষি মন্ত্রণালয়

তিনি বলেন, “এখানে ব্রি-২৮ বা ব্রি-২৯ ধান মোটাটা ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর চিকনটা ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত উঠছে। সবাই তো বিক্রি করছে না। যাদের বেশি দরকার তারা বিক্রি করছে।“

মৌলভীবাজারের হাইল, হাকালুকি ও কাউয়া দিঘী হাওরে ব্লাস্ট রোগে বোরো ধানের বেশ ক্ষতি হয়েছে। উৎপাদন কিছুটা কম হওয়ায় পাইকাররা কৃষকদের কাছ থেকে আশানুরূপ ধান সংগ্রহ করতে পারছেন না।

শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভৈরব বাজার এলাকার পাইকার শহীদ মিয়া জানান, এখন কৃষকরা ধান বিক্রি করছেন কম। কিছু কিছু ধানের চুচা/ছিটা থাকায় সেগুলো তারা কিনছেন না। শহীদ বলেন, তিনি ধানের অবস্থা দেখে ৯০০, ১০০০ ও ১০৫০ টাকা দরে ধান ক্রয় করছেন। ভৈরব বাজার এলাকার কৃষক ফজলু মিয়া জানান, তিনি ১০০০ টাকা দরে আট মণ ধান বিক্রি করেছেন। অন্যান্য বছর ৪০-৫০ মণ ধান বিক্রি করতেন। এবার ব্লাস্ট রোগে তার বেশিরভাগ ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে।

আর নোয়াগাঁও গ্রামের ইছুব মিয়া বলেন, “আমি এবার একটু ভালো ধান ১০০০ টাকা মণ ধরে বিক্রি করেছি। আপাতত পাঁচ মণ ধান বিক্রি করেছি। তিনি বলেন, এবার যে ধান পেয়েছেন সে ধান দিয়ে বছরের খোরাকি হবে না। তারপরও বিক্রি করেছেন মূলত কামলা খরচ দেওয়ার জন্য। শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের লালবাগ গ্রামের আদর মিয়া (৫০) বলেন, এবার তাদের এলাকায় ব্লাস্ট রোগের কারণে ধানে চিটা বেশি হয়েছে। ফলে এসব ধান কিনতে ক্রেতারা আগ্রহী হচ্ছেন না।

“যারা বিক্রি করছেন সর্বোচ্চ ৬০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা দাম পাচ্ছেন।” কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মৌলভীবাজার জেলা উপ-পরিচালক সামসুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সরকারিভাবে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা শুরু হবে। সরকার এবার প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে ৩০ টাকা এবং সেদ্ধ চাল ৪৪ টাকা।

খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকার এবার বাজার থেকে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টন ধান ও চাল কিনবে সরকার। এর মধ্যে চার লাখ টন ধান, ১২ লাখ ৫০ হাজার টন সেদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এমএইচডি/ আই. কে. জে/

ময়মনসিংহ বিভাগ সিলেট বিভাগ সুনামগঞ্জ জেলা মৌলভীবাজার জেলা নেত্রকোণা জেলা হাওর বোরো ধান

খবরটি শেয়ার করুন