শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাবা-স্বামীর সম্পত্তিতে কেন হিন্দু নারীদের অংশ নেই!

সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০১:০৭ অপরাহ্ন, ২০শে জুন ২০২৩

#

সংগৃহীত

কাবেরী মৈত্রেয় :

রুপাই স্যানালের যখন বিয়ে হয় তখন বয়স সবে ১৮ বছর। বাবা-মার তিন সন্তানের মধ্যে মেঝ রুপাই শশুরবাড়িতে গিয়েছিলো বাড়ির বড় সন্তানের বউ হিসাবে। যাবার সময় বাবার বাড়ি থেকে মিলেছিল ৭ ভরির মতো গয়না, ঘটিবাটি, লেপতোষক-বালিশের মতো কিছু। তার সাথে আমার পরিচয় ২০০২ সালে, উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডিটাও পার হয়েছিল কিনা এখন আর মনে করতে পারি না।

তার আগেই একান্নবর্তী সংসারের দায়-দায়িত্ব কাঁধে। প্রথম সন্তান মেয়ের পর পুত্র সন্তানের আশায় পরপর আরো দুই মেয়ে। স্বামীর সহায়-সম্পত্তি বলতে ৫ কাঠার একটি বাড়ি আর আশেপাশের কিছু ধানি জমি। আর ক্ষুদ্র ব্যবসা। সবমিলিয়ে মন্দ চলছিল না। কিন্তু বিয়ের ক-বছর পার না হতেই স্বামী হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়লে, বদলে যায় দৃশ্যপট। চিকিৎসার পেছনে বিপুল টাকা খরচ করেও শেষমেষ বাচাঁনো যায়নি।

এরপর অথৈ সাগরে পড়ে রুপাই। বাবার বাড়ি ফিরবে সে উপায়ও নেই। এরই মধ্যে ভাই বিয়ে করে থিতু হয়েছে। বাবাও পরলোকগমন করেছেন ক-বছর আগে। বাবার সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও রুপাই কিছু পায়নি। কারণ হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী তিনি বাবার কোনো সম্পত্তি পাননি। এদিকে, সংসার সামলানো ছাড়া শশুরবাড়িতেও কোনও কিছুই শেখেনি সে। সঞ্চয় যা ছিলো তাও গেছে স্বামীকে সুস্থ করবার চেষ্টায়। তিন মেয়ের পড়াশোনা, খাদ্য খাবারের দায়িত্ব নেবে কে? শ্বশুরবাড়ি একান্তবর্তী হলেও যে যার মতো, সবারই নিজের সংসার, সম্পত্তিও একক কারো নামে নেই। ভিটে মাটিতে হয়তো থাকবার নিশ্চয়তা আছে, কিন্তু অধিকার তো নেই। 

রুপাইকে যখন জানছি তখন চোখের সামনে লাখো দুভার্গা হিন্দু নারীর মুখটা ভেসে উঠছে। অর্ধ শিক্ষিত, শিক্ষিত হয়েও বেশিরভাগ হিন্দু নারী-ই কষ্টকর একটা অনুভূতির মধ্য দিয়ে ছোট থেকে বড় হচ্ছে, অনিশ্চয়তার হাত ধরে। ছোটবেলা থেকে ভাইবোন একই ঘরে, একই বাবা-মায়ের কোলে চড়ে বড় হচ্ছে। অথচ বড় হয়ে দেখে তাদের দুজনের ভেতর ধর্মীয় আইন বিভেদ রেখা টেনে দিয়েছে। বাবা-মায়ের আদর-ভালবাসা তাদের হলেও সম্পত্তির ছিঁটেফোটাও তাদের নয়। অথচ পরিবারে বাবা-মায়ের আদরের সন্তান ছিল সে বা তারা। বিয়েতে স্বর্ণ, গাড়ি, আসবাবপত্রের মতো নামমাত্র উপহারসামগ্রি নামক যৌতুক দিয়ে মেয়েকে পাত্রস্থ করার নামে যে অন্যায় হিন্দু নারীদের প্রতি যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সোচ্চার হয়নি এ সমাজ ও পারিবারগুলো। 

আরো পড়ুন: যে আট কারণে শিক্ষার্থীদের মেডিটেশন করা দরকার

এদেশে, হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি বণ্টন হয়ে আসছে দায়ভাগ মতবাদ অনুসারে। এই মতবাদে, উত্তরাধিকার নির্ণয় করতে যে নীতি অনুসরণ করা হয়, তা হলো মৃত ব্যক্তির আত্মার সদ্‌গতির জন্য শেষকৃত্য সম্পন্নে যে ব্যক্তি সপিণ্ড দেন তিনিই মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির প্রধানতম অধিকারী। এক্ষেত্রে, মায়েরকুল ও বাবারকুলের শীর্ষ তিন পুরুষ, ছেলে ও মেয়ের অধঃস্তন তিন পুরুষ এবং ওপরে থাকা মা ও পিতারকূলের ছয় পুরুষ হবেন পুরুষ সপিণ্ড।

আর নারী সপিণ্ড পাঁচজন। তাঁরা হলেন, বিধবা স্ত্রী, কন্যা,মা, ছেলের মা আর বাবার বাবার মা। তবে বাবার কুলের সপিন্ডরা যদি জীবিত থাকেন তাহলে মায়েরকুলের সপিন্ডরা সম্পত্তি পান না। সম্পত্তিতে হিন্দু মহিলার অধিকার আইন, ১৯৩৭ অনুসারে বিধবা স্ত্রী তাঁর জীবদ্দশায় মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে পুত্রের সমান জীবনস্বত্ব পাবেন। এর মানে হলো, তিনি সম্পত্তিতে ভাগ না পেলেও ভোগ করতে পারবেন।

তাহলে প্রশ্ন ওঠতে পারে কন্যারা কী পাবে? সে নিয়মেও বৈষম্য রেখেছে হিন্দু সমাজ। নিয়ম মতে, মৃত ব্যক্তির যদি পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র ও বিধবা স্ত্রী না থাকেন, তাহলে মৃত ব্যক্তির কন্যাদের মধ্যে অবিবাহিত কন্যা ও পরে পুত্রবতী কন্যা সম্পত্তি পাবেন। তবে কন্যারা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে জীবনস্বত্ব পান।

যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র, বিধবা স্ত্রী, কন্যা কেউ জীবিত না থাকেন, তাহলে কন্যার পুত্র বা দৌহিত্র সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন। তবে নারীর অর্জিত সম্পত্তির অংশ তার পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ঠিকই পেয়ে থাকেন। এ কারণে হয়তো সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার জন্য হিন্দু ধর্মে পুরুষরা, পুরুষ সন্তানের জন্মকে উৎসাহিত করে কন্যা সন্তানকে নিরুৎসাহিত করে আসছে বছরের পর বছর।

অথচ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশের সংবিধান-১৯৭২ এর  ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে,  সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার। এছাড়াও নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ-১৯৭৯ এ বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে সই করেছে। যেখানে নারীর অধিকার ভোগ ও চর্চার  প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার কথা বলা হয়েছে। সেখানে সম্পত্তিতে সমান অধিকার না থাকার কারণে হিন্দু নারী ও মেয়েরা বিভিন্নভাবে বঞ্চনা, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ভারতে কিন্তু এই অধিকার দেয়া হয়েছে। তাহলে বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের এই অধিকার দিতে সমস্যা কোথায়? সম্পত্তির ভাগ নেই আবার হিন্দু নারীর বিচ্ছেদ নেবার অধিকারও আইনে নেই, পুনর্বিবাহ করা তো দূরে থাক। একটি আধুনিক ও সভ্য রাষ্ট্র হিসাবে যে দেশ বিশ্ব দরবারে প্রতিনিয়ত নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে, সেখানে এমন ধর্মীয় আইন বহাল রেখে হিন্দু নারীদের প্রতি যে অন্যায় তা কতোটুকু যৌক্তিক এখন এটিই প্রশ্ন?

যেখানে পুরো পৃথিবী সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে, সমআইন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আন্দোলন করছে, যাতে নারী-পুরুষে, ধনী-গরীবে, আয় ও সম্পদে বৈষম্য দূর হয়; সেখানে হিন্দু ধর্মে এমন আইন সভ্য সমাজে প্রবেশের মুখে ঠিক কতোটা  বাধা দেয় সেটিও এখন ভাবতে হবে। এদেশের বেশিরভাগ হিন্দু নারী ধর্মীয় খোঁড়া যুক্তির দোহাই দিয়ে বাবা-মায়ের দৃষ্টিভঙ্গির বিভাজন চান না।

তারা চান, রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা করুক, যা দেশের নারী-পুরুষকে সমান অধিকার দেয়ার পথ প্রশস্ত করবে। একটা সমাজে নারীরা যদি স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করতে না পারে, নাগরিক হিসেবে তাদের যে অধিকার সেটা যদি না দেয়া হয়-তাহলে সে সমাজ কখনোই অগ্রসর হতে পারে না। হিন্দু নারীদের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে স্বাধীনতা নামক শব্দ আছে, সামাজিক মর্যাদা আছে, এটি যদি প্রতিষ্ঠা না করা যায় তাহলে সেই সমাজকে উন্নত সমাজ বা অগ্রসর সমাজ বলা যায় না। সেক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায় তাদের নারীদের যদি সম্পত্তির অধিকার না দেয়, তাহলে তাদের অগ্রসর বলা যাবে না। 

কাবেরী মৈত্রেয় : লেখক, সিনিয়র সাংবাদিক  

এসি/ আই. কে. জে/

বাবা-স্বামী সম্পত্তি

খবরটি শেয়ার করুন