ছবি: সংগৃহীত
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও মুসলমানের চোখে হিন্দুরা হিন্দুই থেকে গেল, বাঙালি হতে পারেনি। বাংলাদেশি মুসলমানের একটি বড় অংশের চোখে বাংলাদেশি হিন্দুরা হলো ‘আটকে পড়া ভারতীয়’। অনেক মুসলমান মনে করেন, হিন্দুরা সব ভারতের দালাল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের হাতে যত মুসলমান মারা গেছে, পাকিস্তানিরা তাদের হিন্দু মনে করেই মেরেছে। যে এক কোটি লোক ভারতে শরণার্থী (মুক্তিযুদ্ধের সময়) হয়েছিল, তাদের ৮০ ভাগই ছিল হিন্দু। সংবিধানে যারা বহুত্ববাদের কথা বলছেন; কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারা সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বীজটা যত্ন করে রেখে দিতে চাইছেন।
তিনি বলেন, ১৯৭২ সাল থেকেই দেশের নানা জায়গায় পূজামণ্ডপে হামলা আর প্রতিমা ভাঙচুর হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের (১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ হত্যাকাণ্ডের) পর কাগজে–কলমে বাংলাদেশ হয়ে যায় মুসলমানের দেশ। রাষ্ট্রের অনানুষ্ঠানিক ইসলামীকরণ জিয়াউর রহমানের হাত দিয়ে শুরু, এরশাদের হাতে তার মোক্ষলাভ। শেখ হাসিনা (গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী) ২০ বছর ক্ষমতায় থেকে জিয়া-এরশাদের তৈরি স্থিতাবস্থা বজায় রাখলেন। হিন্দুদের প্রতি তার দরদ ছিল না। তার দরকার ছিল হিন্দু ভোট। মুসলমানের প্রতিও যে তার দরদ ছিল, এমনটি বলা যাবে না।
মহিউদ্দিন আহমদ দৈনিক গণকণ্ঠে কাজ করেছেন প্রতিবেদক ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সুংকোংহে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মাস্টার্স ইন এনজিও স্টাডিজ’ কোর্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক। তিনি বলেন, 'আসলে তার (শেখ হাসিনা) একমাত্র চাওয়া ছিল ক্ষমতার চূড়ায় থাকা। সে জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের অনুভূতি নিয়ে তিনি ডুগডুগি বাজিয়েছেন আর হিন্দুদের রেখে দিয়েছেন জিম্মি করে। ক্ষমতার ভিত টিকিয়ে রাখতে নির্ভর করেছেন ভারতের ওপর। সরকার চালিয়েছেন সামরিক-অসামরিক গোয়েন্দা আর সরকারি-বেসরকারি লাঠিয়াল দিয়ে।
কলামিস্ট ও মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, দেশে কটূক্তি, ধর্ম অবমাননা, অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া—এসব অভিযোগ তুলে হামলা-মামলা চলে আসছে অনেক দিন ধরে। নিকট অতীতে রামু, নাসিরনগর, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার ধুয়া তুলে দুর্বল সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর জুলুম হয়েছে। অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার নালিশ জানালেই হলো। পুলিশ বিদ্যুৎগতিতে তাকে ধরে নিয়ে যাবে। আদালতে রিমান্ড চাইবে। আদালত সঙ্গে সঙ্গেই দিয়ে দেবেন। এই ফর্মুলার নড়চড় হতে দেখছি না।
দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে তিনি এসব কথা বলেন। 'ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে বহুত্ববাদ: ভাবের ঘরে চুরি' শিরোনাম তার এ কলাম পত্রিকাটির আজ শুক্রবারের (১লা আগস্ট) ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। ইসলামের প্রচারক মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে এক হিন্দু কিশোরের বিরুদ্ধে ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগ তুলে সম্প্রতি রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হওয়ার ঘটনার উল্লেখ করে তিনি লেখাটি শুরু করেন।
ধর্ম বিশারদদের মতে, সনাতন ধর্ম পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছে ধ্যান ও একের মধ্যে বহুত্বের অবস্থান বা নানা মুনির নানা মত। মহিউদ্দিন আহমদও লেখায় সনাতন ধর্মের সহনশীলতার একটি উদাহরণ তুলে ধরেছেন। তিনি লেখেন, ধর্ম একটি স্পর্শকাতর বিষয়। সম্প্রতি একটি পুরোনো বাংলা ছবির সংলাপ শুনলাম। উত্তম কুমার বলছেন, ‘ভগবানে আমার বিশ্বাস নেই।’ এতে তো ধর্মপ্রাণ হিন্দুর অনুভূতিতে প্রচণ্ড আঘাত লাগার কথা; কিন্তু সে রকম কিছু হয়েছে বলে শুনিনি। উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তায় একটুও ভাটা পড়েনি।
প্রসঙ্গত, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তা এখনো পূরণ হয়নি। ধর্মনিরপেক্ষতার নানা অপব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক দলগুলোর নানা রকম আপসের কারণে মানুষের মনস্তত্ত্বে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এ কারণে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরের বছর থেকেই ঘটছে। সমাজের মুখ্য একটি অংশের সেই সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে মহিউদ্দিন আহমদের লেখায়।
এদিকে, গত বছরের ৫ই আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে ‘রাজনৈতিক ট্যাগ’ দিয়ে অস্বীকারের প্রবণতা রয়েছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। বিষয়টিকে দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক বলে উল্লেখ করেছে তারা। ঐক্য পরিষদ বলেছে, এই অস্বীকার করা এবং প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় না আনার কারণে সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। এর ফলে সংখ্যালঘুরা আরও হুমকির মুখে পড়েছে, পড়ছে। জাতিগত সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতাও ক্রমেই বাড়ছে।
খবরটি শেয়ার করুন