বুধবার, ২৩শে অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৭ই কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছাতিম ফুলের ঘ্রাণে মাতাল চারিদিক!

লাইফস্টাইল ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০২:৪২ অপরাহ্ন, ১৯শে অক্টোবর ২০২৪

#

ছবি : সংগৃহীত

প্রকৃতিতে এসেছে হেমন্ত। আশ্বিনের শেষ থেকে কার্তিকের দিনগুলো শেষ হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। আলতো রোদ গায়ে মাখতেই পালায় দুপুর। এরপর বিকেল আর সন্ধ্যা তড়িঘড়ি করেই জানান দেয় নিজেদের অবস্থান। বাড়তে থাকে রাতের ব্যাপ্তি। অবশ্য কর্মব্যস্ত জীবনে দুপুর কিংবা সন্ধ্যার হদিস রাখার অবসর মেলে না আমাদের। 

বিকাল বা সন্ধ্যা মানে অসংখ্য মানুষের কাছে বাড়ি ফেরার লগ্ন। সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে নীড়ে ফেরার তাড়া। ট্রাফিক জ্যাম পার করে কখন ঘরে পৌঁছাবেন তার সময় গুণতে থাকেন সবাই। ঠিক এমন সন্ধ্যাগুলোতেই পেট্রোল-ডিজেলের ধোঁয়া, ধুলাবালি, আবর্জনার উৎকট গন্ধ ছাপিয়ে নাকে এসে পৌঁছে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ। এ যেন বহু চেনা তবু অচেনা। কিছুটা শীতের বার্তা আর কিছুটা ছেলেবেলা মিশে আছে সেই ঘ্রাণে। ক্লান্ত পথিক ঘ্রাণের উৎস খুঁজতে শুরু করেন। একসময় বুঝতে পারেন নেশাতুর বুনো এই সৌরভ ছাতিমের। 

ছাতিমকে বলা হয় হেমন্তের অগ্রদূত। প্রতিবছরই শহর থেকে শুরু করে বন্দর, মফস্বল কিংবা পাড়াগাঁয়ে এর সরব উপস্থিতি দেখা যায়। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলতি বছর ছাতিম নিয়ে আলোচনা একটু বেশিই হচ্ছে বলা যায়। এর কারণ হতে পারে, ছাতিমের আধিক্য। সাধারণত আর্দ্র, কর্দমাক্ত, জলসিক্ত স্থানে ছাতিম বেশি জন্মে। এ বছর হয়তো অনুকূল পরিবেশ পাওয়ায় ছাতিমের সংখ্যা বেড়েছে। আর এই ফুলের ঘ্রাণের ব্যাপ্তি এতই বেশি যে তাকে এড়ানোর সুযোগ নেই। 

ছাতিমের আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। ক্রান্তীয় অঞ্চলের গাছটি বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র জন্মে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য উদ্ভিদ এটি। এই গাছের মূলাবর্তে সাতটি পাতা এক সঙ্গে থাকে বলে সংস্কৃত ভাষায় একে 'সপ্তপর্ণ' বা 'সপ্তপর্ণা' নামে ডাকা হয়। 

সুবিন্যস্ত লম্বাটে পাতাগুলোর মাঝ বরাবর ফোটে সফেদ রঙা থোকা ফুল। পাতার আধিক্য থাকায় গাছকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন প্রকৃতি সবুজ রঙের ছাতা মেলে ধরেছে। সম্ভবত একারণেই এই গাছের নাম ছাতিম। আর গাছের নামেই ফুলের নামকরণ। অঞ্চলভেদে এটি ছাতিয়ান, ছাইত্যান, ছাতইন ইত্যাদি নামে পরিচিত। ছাতিমের পাতা দিয়ে গ্রাম্য শিশুরা খেলনা ঝুড়িও বানিয়ে থাকে। 

আরো পড়ুন : এই গাছের নাম কেন ‘মানি প্ল্যান্ট’, জানা আছে কি?

ছাতিম গাছ লম্বায় প্রায় ৪০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। একাধিক শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট গাছটির ছাল অসমতল ও ধূসর। এর পাতার ওপরের অংশ চকচকে আর তলার দিক ধূসর। পাতাগুলো ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। শরতের শেষ থেকে হেমন্তে সারা গাছ ভরে গুচ্ছবদ্ধ, তীব্রগন্ধযুক্ত, হালকা ঘিয়ে রঙের ছোট ছোট ফুল ফোটে। 

যান্ত্রিকতায় ভরপুর এই শহরে ছাতিম যে দুর্লভ তা কিন্তু নয়। শহরের অসংখ্য স্থানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গাছটি। আর তার বুনো সৌরভে মাতাল করছে শহরবাসীকে। রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, গণভবনের রাস্তা, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন সড়ক, মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, রমনা পার্ক, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, জাতীয় তিন নেতার মাজার প্রাঙ্গণ, জাতীয় প্রেসক্লাব সংলগ্ন চামেরি হাউস, আব্দুল গনি রোড, হাতিরঝিল, ইস্কাটন, বারিধারা ডিপ্লোমেটিক জোন- সর্বত্র রয়েছে ছাতিমের উপস্থিতি। 

প্রকৃতিতে নিজেই নিজের অবস্থান সৃষ্টি করা একটি গাছ ছাতিম। শখ করে এই গাছ তেমন একটা কেউ লাগান না। তবু সারা দেশে বিক্ষিপ্তভাবে ছাতিমগাছ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কারণ কি জানেন? ছাতিমের বীজের রয়েছে বাতাসে ভেসে বেড়ানোর দারুণ এক ক্ষমতা। ছোট কাঠির মতো বীজের এক প্রান্তে থাকে পশমের মতো অঙ্গ। ফল ফেটে বীজ বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে তা বাতাসে ভেসে ভেসে অনেক দূরে চলে যায়। আর সুবিধামতো জায়গায় সেই বীজ পড়লেই গজিয়ে ওঠে নতুন গাছ। 

ছাতিমের বৈজ্ঞানিক নাম অ্যালস্টনিয়া স্কলারিস (Alstonia scholaris)। ইংরেজিতে একে Blackboard Tree বলা হয়। স্কলারিস আর ব্ল্যাকবোর্ডের সঙ্গে বিদ্যা অর্থাৎ লেখাপড়ার যোগ আছে। এর কারণও আছে। ছাতিমের নরম কাঠ থেকে ব্ল্যাকবোর্ড ও পেনসিল তৈরি হয়। প্যাকিং বাক্স, দেশলাইয়ের কাঠি এবং খুব সাধারণ মানের আসবাব তৈরিতেও এ গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শ্রীলঙ্কায় ছাতিমের কাঠ দিয়ে কফিন বানানো হয়। 

ছাতিমে ঔষধি গুণ রয়েছে। এর ছাল ও আঠা জ্বর, হৃদরোগ, হাঁপানি, ক্ষত ও কুষ্ঠ রোগ নিরাময়ে সহায়ক। আমাশয়ের চিকিৎসায়ও এর ব্যবহার রয়েছে। চর্মরোগেও ছাতিম ফলপ্রদ। স্নায়ুর শক্তিসূত্রে অসাড়তা আনে বলে রক্তের চাপ কমাতে ছাতিম উপকারী।

উপকারিতা থাকলেও ছাতিম থেকে কিন্তু সাবধানেও থাকা উচিত। ইংরেজিতে গাছটিকে Devil's Tree বা শয়তানের গাছও বলে। কারণ, ছাতিমের ঘ্রাণে মাদকতা থাকলেও এর তীব্র ঘ্রাণ অনেকেই সহ্য করতে পারেন না। এই ফুলের রেণু থেকে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। ছাতিম গাছ থেকে নিঃসৃত রজনজাতীয় সাদা রস থেকেও সংক্রমণ হতে পারে। 

ছাতিমের তীব্র ঘ্রাণে দেখা দিতে পারে মাথা ব্যথা, গা গোলানো, বমি বমি ভাবের মতো সমস্যাও। বিশেষত সাইনাসাইটিস, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, চোখের সংক্রমণ বা ক্রনিক সর্দিকাশির সমস্যা থাকলেও ছাতিম ফুলের গন্ধ থেকে সমস্যা হতে পারে। 

এস/ আই.কে.জে/


ছাতিম ফুল

খবরটি শেয়ার করুন