ছবি: সংগৃহীত
ক্ষমতায় তখন আওয়ামী লীগ। দলটির সমর্থক জ্যেষ্ঠ এক সাংবাদিক বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার পান। এ বিষয়ে বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে প্রতিবেদন সাজানোর সময় বার্তাকক্ষের এক সাংবাদিক মন্তব্য করেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে আর অমুক সাংবাদিকেরও পুরস্কার দখল শুরু হয়ে গেছে।’ বার্তাকক্ষে বসে ‘অব দ্য রেকর্ডে’ করা ওই সাংবাদিকের মন্তব্য টিভি চ্যানেলটিতে সংশ্লিষ্টদের অসর্কতার কারণে ‘অন এয়ার’ (সম্প্রচারিত) হয়ে যায়। এ নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে তখন পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হয়।
অনেকের যুক্তি ছিল, বার্তাকক্ষে ‘অব দ্য রেকর্ডে’ নানাজন সম্পর্কে নানা কথা হয়। অসাবধানতাবশত সম্প্রচারিত হয়ে গেলেও সেটা ‘অব দ্য রেকর্ডের’ই বিষয়। কেউ কেউ বলেন, জ্যেষ্ঠ ওই সাংবাদিক সম্পর্কে বার্তাকক্ষে বসে এমন মন্তব্য করা উচিত হয়নি। সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এখন এর সরাসরি সম্প্রচারিত (লাইভ) অনুষ্ঠানে যখন একটি প্রতিবেদন প্রচার হচ্ছিল, তখন একই ঘটনা ঘটে।
এখন’র অনুষ্ঠানটির উপস্থাপিকার সঙ্গে আরেকজনের কথোপকথন সম্প্রচারিত হয়ে যায়। অনুষ্ঠানে হঠাৎ চলে আসা কথোপকথনে ওই উপস্থাপিকাকে গালি দিতে শোনা যায় নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দুই মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের উদ্দেশে।
এই ঘটনায় উপস্থাপিকাসহ তিনজনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে এখন কর্তৃপক্ষ। ঘটনাটির পক্ষে-বিপক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে নানা আলোচনা। গালি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধি-বিধান আছে কী না, আইনে কোনো বাধা আছে কী না, কাউকে গালি দেওয়া মত প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে কী না, এসব প্রশ্নও সামনে আসছে।
হাসনাত আব্দুল্লাহ নিজেও এ বিষয়ে ফেসবুক একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি বৃহস্পতিবার (১৩ই মার্চ) মধ্যরাতে নিজের ভেরিফায়েড আইডি থেকে স্ট্যাটাস দিয়ে ওই টিভির সাংবাদিকদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি লেখেন, ‘আমরা এই দ্বিমত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যই আন্দোলন করেছিলাম। আপনার এই গালির স্বাধীনতার জন্যই আন্দোলন করেছিলাম। শুধু মত প্রকাশ নয়, দ্বিমত প্রকাশও অব্যাহত থাকুক।’
আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, কাউকে গালি দেওয়া যাবে কী যাবে না, দেশের আইনে এ বিষয়ে সরাসরি কিছু বলা নেই। তবে কেউ মানহানিকর শব্দ ব্যবহার করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। অবশ্য কোন ধরনের বক্তব্য মানহানিকর, আইনে তা খুব সীমিতভাবে বলা আছে। এক্ষেত্রে কোন শব্দটা মানহানির, তা সমাজের প্রথা হিসেবে ধরে নিতে হবে। মানহানিকর বলতে এর আওতায় গালি দেওয়ার বিষয়কেও আনা যায়।
তারা বলেন, আইনে কারো গালি দেওয়ার অধিকার নেই। কাউকে গালি দিয়ে অপমান করা আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারামতে, কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক শব্দ বা চিহ্ন ব্যবহার বা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে নিন্দা প্রণয়ন বা প্রকাশ করলে এতে ওই ব্যক্তির মানহানি হয়েছে মর্মে গণ্য হবে। মৃত ব্যক্তিরও খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট হয়, এমন কোনো বক্তব্য দিলেও এই ধারায় মানহানির মামলা হতে পারে।
দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায় মানহানির ক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার কথাও বলা আছে। অনলাইনে যদি কেউ মানহানিকর বক্তব্য দেন, তার জন্যও আইনি বিধান আছে। ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ এর ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিকস বিন্যাসে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে তা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে ধরা হবে এবং এর জন্য তিনি অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
গালি দেওয়া মত প্রকাশের স্বাধীনতার আওতায় পড়ে না। গালি দেওয়াকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলা যায় না। কাউকে অপমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা বা মানহানিকর বক্তব্য দেওয়া কখনোই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আওতায় পড়ে না। কারণ, গালি কোনো স্বাভাবিক কথোপকথন নয়। মতপ্রকাশ মানে কোনো বিষয়ের ওপর মতামত প্রকাশ করা। গালি হলো এমন শব্দ, যা দিয়ে আরেকজনকে আহত করা হয়।
একাধিক আইনজীবী বলেন, কেউ কোনো অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে সত্য প্রকাশ করা যায়। কিন্তু কাউকে অপমান করা বা গালি দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনে বারবার ভালো উদ্দেশ্যে অভিমত প্রকাশের কথা বলা হচ্ছে, গালাগালির কথা বলা হয়নি।
এইচ.এম/
খবরটি শেয়ার করুন