তাপস দাস
বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের রথ হয়তো আর থামবার নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশটি সাম্প্রতিক গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্স (২০২৩) এ তিনধাপ এগিয়ে ১৬৩টি দেশের মধ্যে ৪৩তম স্থান অধিকার করেছে, যা কিনা দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশের থেকে উত্তম। এই তালিকায় ভারত ১৩তম এবং পাকিস্তান ৬ষ্ঠ স্থানে রয়েছে। এর থেকেও আশ্চর্যের বিষয় বাংলাদেশের স্থান বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকেও উপরে । সাম্প্রতিক গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থান ৩০। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান শর্ত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, যা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করে। ২০১৬ সালের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর থেকে বাংলাদেশ সরকার কঠোর নীতি গ্রহণের মধ্যে দিয়ে আজ এই পর্যায় পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ পিস্ অবজারভেটরির এক গবেষণা থেকে উঠে এসেছে , গত ৭৫ মাসে বাংলাদেশে সহিংস উগ্রবাদের কারণে ২২২ জনের মৃত্যু ঘটেছে অর্থাৎ বাংলাদেশে সহিংস উগ্রবাদের কারণে গড়ে ৩৫ জন করে মারা যায়। কিন্তু আর্শ্চযজনকভাবে এটি যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া সহিংস উগ্রবাদের ফলে নিহতের সংখ্যার অর্ধেকেরও কম। বস্তুত শুধু ২০১৯ সালের প্রথম নয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে কট্টর ডানপন্থীদের দ্বারা ৭৭ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছে। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৯৫ জন।
তবে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ কোনো নতুন ধারণা নয়। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সূচনা মূলত আশির দশকে আফগানিস্তানফেরত মুজাহিদীনদের মাধ্যমে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে ক্ষমতায় থাকার কৌশল হিসেবে তৎকালীন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে এই সন্ত্রাসী মৌলবাদীদের গোপন আঁতাত গড়ে ওঠে যা ৯০-এর দশকে বাংলাদেশ দেশীয় মৌলবাদীদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর একটি ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। প্রথম দিকে কিছু বুদ্ধিজীবী এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের ওপর হামলা চালালেও ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩টি জেলায় বোমা হামলার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের শক্তি প্রদর্শিত হয় । এর পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান ঘটনা বাংলাদেশকে সচকিত করে।
যদিও তৎকালীন রাজনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতি এর জন্য অনেকটাই দায়ী। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণেই যে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছে তা বলা যাবে না। এর কারণ প্রথিত ছিল সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পর্যায়। সামাজিক বৈষম্য, বেকারত্ব, রাজনীতি এবং শিক্ষার ধর্মীয়করণ এর জন্য অনেক অংশে দায়ী।
কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ মানবিক উন্নয়নেও দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশের থেকে এগিয়ে যা বাংলাদেশকে গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্সে অগ্রগতির ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। তাছাড়া ২০০৯ সালে সন্ত্রাসবিরোধী আইন (২০২৩ সালে সংশোধিত), মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ (সন্ত্রাসী তহবিল সংক্রান্ত বিধান যুক্ত করার জন্য ), গোয়েন্দা সমন্বয়ের জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এছাড়াও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত একটি ১৭-সদস্যের জাতীয় কমিটি এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক মনোনীত সমস্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার । যাতে মাদ্রসার ছাত্ররা জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়িয়ে না পড়ে তার জন্য সরকার আলিয়া এবং কওমি মাদ্রাসাগুলিকে মূলধারার শিক্ষা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, এর ফল হয়েছে সুদূর প্রসারী।
২০১৬ সালের পর থেকেই বাংলাদেশ সরকার জঙ্গি দমনে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে । জঙ্গিদের ট্র্যাক করার জন্য একটি জিরো-টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে , অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) চালু করা হয়, অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) দ্বারা একটি যৌথ ক্লিয়ারেন্স অপারেশন কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল। ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের ফলে ৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, ৫১২ জনের বেশি গ্রেপ্তার হয়েছে। তাছাড়া, সরকার সাইবারস্পেস এবং সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নজরদারিও বাড়িয়েছে যেখানে সন্ত্রাসীরা যাতে তাদের নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করতে না পারে ।
যদিও আগামী দিনে বাংলাদেশকে আরো বেশ কিছু বিষয় খুব তৎপরতার সঙ্গে দমনের উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন - ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের উত্থান ঘটেছে , জাতিগত গোষ্ঠী এবং সন্ত্রাসীদের মধ্যে একটি নতুন সম্পর্ক তৈরী হয়েছে । পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ক্রমবর্ধমান জাতিগত সহিংসতা বিশেষ করে যখন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে সহায়তা করছে। সুতরাং বাংলাদেশকে আগামী দিনে রাজনৈতিক সদিচ্ছার সাথে এই বিষয়গুলি নিয়ে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
তাপস দাস: গবেষক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।
খবরটি শেয়ার করুন