রবিবার, ১৩ই এপ্রিল ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করতে সংস্কার এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ প্রধান উপদেষ্টার *** 'পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের সংঘাত নেই' *** ফিলিস্তিনিদের দাবির সঙ্গে বাংলাদেশের সবাই আছে *** খেলাধুলার জগতে এখন রোনালদো সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড *** সোনালি দিনের সুবাতাস ঢাকাই সিনেমায় *** ১০ শতাংশ বেসলাইন শুল্ক থেকে অব্যাহতি পাবে অধিকাংশ দেশ, ট্রাম্পের ইঙ্গিত *** লাখো মানুষের স্লোগানে মুখরিত ঢাকা *** বাটা, কেএফসি’তে ভাঙচুর-লুটপাটের নেপথ্যে কারা? *** ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতিতে একজনকে আগুন দিতে দেখা গেছে: ঢাবি প্রক্টর *** সৌদি রাষ্ট্রদূতের অভিযোগের ভিত্তিতে মডেল মেঘনা কারাগারে

পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে ‘খ্রিষ্টান রাষ্ট্র’ গঠনের ‘ষড়যন্ত্রের’ সত্যতা কতটা?

বিশেষ প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০৭:৪৪ অপরাহ্ন, ১২ই এপ্রিল ২০২৫

#

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) অভিযোগ, ‘দেশের বান্দরবান জেলা, মিয়ানমারের রাখাইন ও ভারতের মণিপুর, মিজোরাম রাজ্য নিয়ে আলাদা খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গঠন করার ষড়যন্ত্র চলছে। এর অংশ হিসেবে আমাদের দেশেও আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কেউ অগ্রসর হচ্ছেন কী না, বা উদ্যোগ নিচ্ছেন কী না, এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে।’

শুক্রবার (১১ই এপ্রিল) ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে’ বাসদের আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে দলটির সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ এ অভিযোগ করেন। হঠাৎ করে দলটি এ অভিযোগ করলেও দীর্ঘ বছর ধরেই গুঞ্জন আছে, এশিয়ায় ‘স্বাধীন খ্রিষ্টান রাষ্ট্র’ গঠন করার ‘পরিকল্পনা’ আছে আমেরিকার। এ লক্ষ্যে আমেরিকা নানা সময় ‘ষড়যন্ত্র’ করে থাকে।

এমন ‘প্রচারণা’ও আছে, ‘দেশের তিন পার্বত্য জেলা (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) নিয়ে আলাদা খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গঠন চায় আমেরিকা।’ এশিয়ার কয়েকটি দেশের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি মাঝেমধ্যে এ ‘গুঞ্জনের’ কথা এত গুরুত্ব দিয়ে বলেন যে, তাতে আঁচ-অনুমানের শাখা-প্রশাখা আরও বাড়ে।

প্রশ্ন হলো, বাস্তবে এ রকম একটা কল্পিত ‘খ্রিষ্টান জনসংখ্যাপ্রধান রাষ্ট্র’ গঠনের ‘ষড়যন্ত্রের’ সত্যতা কতটুকু? নাকি এটা শুধু ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের জুজু দেখানোর রাজনৈতিক কৌশলমাত্র? মূলধারার রাজনীতি তার নিজের স্বার্থেই কী ‘খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের’ গুঞ্জনে বেশি আগ্রহী? নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আমেরিকা ও এর মিত্রদের কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতার সময়ে বাসদ কেন এমন অভিযোগ সামনে নিয়ে এলো?

‘খ্রিষ্টান রাষ্ট্র’ গঠনের ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ কেন করছেন, সুখবর ডটকমের এমন প্রশ্নের জবাবে বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে ইতিমধ্যে আপনারা দেখেছেন যে, মেক্সিকো গালফকে বলছে, এটা আমেরিকান গালফ। তিনি বলছেন, গ্রিনল্যান্ড আমেরিকার সম্পত্তি হবে, আমেরিকার দখলে থাকবে। কানাডাকে বলছে, তোমরা আলাদা রাষ্ট্র থাকতে পারবা না, তোমরা আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। তিনি একের পর এক এ ধরনের ঘোষণা দিচ্ছেন।’

বজলুর রশীদ বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়েও চক্রান্ত চলছে। চীনের অর্থনীতি ঠেকানোর জন্য রাখাইন, বান্দরবান, মিজোরাম ও মণিপুর নিয়ে একটা রাষ্ট্র দরকার, আমেরিকা যেখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করে খবরদারি করতে পারবে, এ অঞ্চলের কর্তৃত্ব করতে পারবে।’

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক ও সাংবাদিক আলতাফ পারভেজ মনে করেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় খ্রিষ্টান রাজ্যের গুঞ্জন শুধু খ্রিষ্টানদের সংখ্যাগত বৃদ্ধির কারণে নয়; উল্লিখিত এলাকাগুলোর অনেক বৈশিষ্ট্যও এ বিষয়ে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, চীন, মণিপুর, বান্দরবানের একাংশ এবং অরুণাচলের মধ্যে অনেক এলাকায় নানা ধরনের দাবিতে নিরস্ত্র-সশস্ত্র ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। কোথাও কোথাও সশস্ত্রতার ধরন অনেক ব্যাপক ও গভীর, কোথাও তা মৃদু, কিন্তু অগ্রাহ্য করার মতো নয়।’

গবেষকদের প্রশ্ন- দক্ষিণ এশিয়ার খ্রিষ্টান সমাজ বা উল্লিখিত জনপদগুলো কি কখনো ‘খ্রিষ্ট ধর্মভিত্তিক নতুন কোনো রাষ্ট্রের’ দাবি তুলেছে? এর জন্য কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন আছে? এ রকম দাবির সপক্ষে খ্রিষ্টান সমাজের বা গির্জামণ্ডলীর কোনো ইশতেহার আছে? সচরাচর এসব প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য উত্তর পাওয়া যায় না।

তারপরও ক্রমাগত এ রকম দাবি ও গুঞ্জন উঠছে। সেটা ঘটছে মুখ্যত অখ্রিষ্টানদের তরফ থেকে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশে বিশেষ বিশেষ মতাদর্শের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই বিষয়টি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতে ‘স্বরাজমার্গ’ নামে হিন্দুত্ববাদী একটা বিখ্যাত মিডিয়া এ ইস্যুতে বেশ এগিয়ে রয়েছে। 

তবে বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের নেতা অ্যালবার্ট ডি কস্টা কয়েক মাস আগে এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের প্রচার তাদের সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের দূরত্ব সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি করছে।’

অনেক গবেষকের মতে, দেশের তিন পার্বত্য জেলা বা ভারতীয় কয়েকটি রাজ্যের অংশ নিয়ে আমেরিকা নতুন ‘খ্রিষ্টান রাষ্ট্র’ গঠন করতে চায়, এটা নিতান্তই প্রচারণা মাত্র। যা দেশের কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন ও ভোলার মনপুরা দ্বীপ আমেরিকার কথিত দখল করার মতো প্রচারণা। ভারত ও বাংলাদেশের বামনেতারা এমন প্রচারণা বিভিন্ন সময় সামনে আনলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে অন্য দলগুলোও তা লুফে নেয়। 

জানা যায়, ২০২৩ সালে দেশের রাজনীতিতে সেন্ট মার্টিনের বিষয়টি আবার আলোচনায় আনেন আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন (বর্তমানে কারাগারে আছেন)। তিনি ওই বছরের ১৪ই জুন জাতীয় সংসদে সেন্ট মার্টিন ইস্যুটি তোলেন। এরপর আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে, ‘আমেরিকা বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নিয়ে নিতে চায় এবং বিএনপি দ্বীপটি বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়।’

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ভোলার মনপুরা দ্বীপটি আমেরিকাকে দিয়ে দেওয়ার অভিযোগের কথা প্রথম শোনেন। ওই বছরের ২৮শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডের বৈঠক হয়। ওই বৈঠক ঘিরে চীনপন্থী বাম দলগুলো অপপ্রচার চালায় যে, মনপুরা দ্বীপ আমেরিকাকে দেওয়া হচ্ছে। এর বদলে বাংলাদেশকে সমর্থন দেবে আমেরিকা।’

মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘তখন সেন্ট মার্টিন এতটা পরিচিত ছিল না। পরিচিত ছিল মনপুরা। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে মনপুরার নাম সবার মুখে ছড়িয়ে পড়ে।’

জানা যায়, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ১৯৮০ সালের ১৮ই ডিসেম্বর দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতির শিরোনাম ছিল, ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কাউকে নৌঘাঁটি করতে দেওয়া হবে না।’ 

ওই বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘আমেরিকাকে সেন্ট মার্টিনে নৌঘাঁটি করতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে কয়েকটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল যে অভিযোগ করেছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’ জিয়াউর রহমানের সরকারের বিরুদ্ধেও ওই অভিযোগ করেছিল কয়েকটি বামদল।

এইচ.এস/


খ্রিষ্টান রাষ্ট্র

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন